গেল ১৫ বছরে মিন্টু রোডে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ-ডিবি কার্যালয়ের অভ্যন্তরে গণমাধ্যমে প্রচারের জন্য যে শুটিংগুলো ধারণ করা হয়েছে, এটি তার একটি।
সজিব ও নিলয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, বিদেশ যেতে আগ্রহীদের জন্য প্রয়োজনীয় পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট জাল করে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। প্রতারক চক্রের তথ্য দিতে যথারীতি তৎকালীন ঢাকা মহানগর ডিবি প্রধানের সংবাদ সম্মেলন। ২০২২ সালের ৪ আগস্টে ডিবি পুলিশের দায়ের করা এই মামলায় প্রায় দেড় মাস কারাভোগও করেছেন এই দুই যুবক।
কিন্তু গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে অনেক ঘটনার মতোই প্রশ্ন উঠেছে এই অভিযান ও মামলা নিয়ে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ যাচাইয়ে এখন টিভি ডিবির মামলায় জেলখাটা সজিব ও নিলয়ের মামলার আদ্যোপান্ত খোঁজ নিতে শুরু করে। জানা যায়, ২০২২ সালের ১ আগস্ট জনশক্তি রপ্তানি কোম্পানি জেএসএন ইন্টারন্যাশনালের প্রধান কার্যালয়ে অভিযান চালায় ডিবি পুলিশ। সেখান থেকে পাঁচটি ভুয়া পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের সনদ ও ৬টি ভুয়া সিল উদ্ধার করার কথা জানায় ডিবি।
এর মধ্যে ২০১৯ সালের ১৭ মে শরীয়তপুরের জাজিরার মো. বিলাল হোসেনের নামে ইস্যু করা জেলাটির পুলিশের বিশেষ শাখার তৎকালীন পুলিশ সুপার স্বাক্ষরিত একটি ক্লিয়ারেন্সও রয়েছে। ডিবির ভুয়া হিসেবে দাবি করা বাকি ৪টি ক্লিয়ারেন্স সনদের ৩টিও শরীয়তপুর এসবি থেকে ইস্যুকৃত। বাকি একটি ঢাকা থেকে।
সেদিনই ঐ সংস্থার এমডি ও সিইও সজিব ও নিলয়কে সেখান থেকে আটক করা হলেও ডিবি তাদের গ্রেপ্তার দেখায় ৪ আগস্ট। এরপর এই ঘটনায় করা হয় মামলা, যার বাদী ডিবির অর্গানাইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের উপ-পরিদর্শক আসিফ ইকবাল। পরে রিমান্ডে নেয়া হয় আসামিদের, পাঠানো হয় কারাগারে। এর প্রায় সাত মাস পর এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে গোয়েন্দা সংস্থাটির একই বিভাগের উপ-পরিদর্শক মোহাম্মদ আল আমিন মীর।
মামলার এজাহারে ও চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়, বনানীর ৬ নম্বর রোডের জীল মরিয়ম ভবনের তিন তলার জেএসএন ইন্টারন্যাশনালের অফিসে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন সেখানে প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব না থাকলেও ভবনটির নিরাপত্তাকর্মী জানান, অফিসটি ছিল ভবনটির পঞ্চম তলায়। এখানেও ট্রেড লাইসেন্সের সঙ্গে মামলার এজাহারের তথ্যের গড়মিল।
অভিযোগপত্রে দেখানো হয়, মো. বিলাল হোসেন, রুহুল আমিন মাদবরসহ বাকি ৩টি ক্লিয়ারেন্সের তথ্যও। জব্দ তালিকায় দেখানো সেই পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেটগুলোর কয়েকটি এখন টিভির প্রতিবেদকের কাছে। এ বিষয়ে ভুক্তভোগীরা কী বলছেন?
ভুক্তভোগী সামিউল ইসলাম সজীব এখন টিভিকে বলেন, ‘একদম সিভিলে ৮ জন মানুষ আসেন। এসেই আমার অফিস ভাঙচুর শুরু করে। একটা গাড়িতে বসিয়ে নিয়ে যায়। আমরা কোথায় যাচ্ছি, কী করছি, আমরা কিছুই জানি না। ৪টা-৫টা প্রিন্ট করা পুলিশ ক্লিয়ারেন্স এবং কিছু সিল রেখে আমাদের দাঁড় করিয়ে প্রেস। ৪২ দিন আমি নিরপরাধ একটা ছেলে জেলে ছিলাম।’
এবার জব্দ তালিকায় দেখানো পুলিশের দেয়া এই ছাড়পত্রগুলো শরীয়তপুর এসবি অফিসে গিয়ে যাচাই করি। যাচাই-বাছাই শেষে জেলাটির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জানায়, পুলিশ ক্লিয়ারেন্সগুলো জাল নয়, ৪টির সঠিক সেই তথ্য রয়েছে পুলিশের ওয়েবসাইটে।
শরীয়তপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শেখ শরীফ উজ-জামান বলেন, ‘৫টি ভেরিফিকেশন সার্টিফিকেট আমরা চেক করেছি। চেক করে আমরা যেটি দেখতে পেয়েছি যে, এটি আমাদের জেলা থেকেই ইস্যুকৃত। এই ডেটাটা আমরা চেক করে দেখেছি এই সার্টিফিকেটগুলো জাল না।’
পুলিশের দেয়ার মামলার সম্পূরক অভিযোগপত্রে পুলিশের দেয়া এই সনদগুলোর নাম পরিচয় ঠিক থাকলেও, ইস্যুকৃত তারিখ, রেফারেন্স নম্বর, কোথাও কোথাও ইস্যু করা পুলিশ কর্মকর্তাদের নামের ক্ষেত্রেও ভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। প্রশ্ন হলো, সঠিক ছাড়পত্র সনদ নকল করে অসামঞ্জস্য তথ্যের সনদ তৈরি তাহলে তৈরি করলো কে? ভুক্তভোগীদের আঙুল তৎকালীন ডিবির কর্মকর্তা নাজমুলের বিরুদ্ধে। যদিও এ ব্যাপারে আর কথা বলতে রাজি নন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আল আমিন মীর।
তিনি বলেন, ‘এক কথায় এখন এটা বিচারাধীন। আমি চার্জশিট দিয়ে আসছি। বাকিটা আদালতের সিদ্ধান্ত।’
সামিউল ইসলাম সজীব বলেন, ‘এডিসি নাজমুলকে চ্যালেঞ্জ করছি, আমাকে একটা জিডি দেখাক।’
এখন প্রশ্ন উঠেছে, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট জাল, লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ দেখিয়ে মামলা দিয়ে কারাভোগ করানোর নেপথ্যে আসলে কে? এখানে অভিযোগের তীর নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের নেতা আবু সাঈদ মজুমদারের ভাগ্নে সিফাতুল বাশারের বিরুদ্ধে। সে নিজেও একজন প্রবাসী এবং মানবসম্পদ রপ্তানির সঙ্গে জড়িত।
২০২৩ সালে সজিব-নিলয়সহ একাধিক ভুক্তভোগী সিফাতুল বাশারসহ বেশ কয়েকজনের নামে প্রতারণার অভিযোগে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা করলে মোড় ঘুরে যায় ঘটনার।
ডিবির দায়ের করা মামলায় কারাভোগ করে সজিব-নিলয়। একই অভিযোগে সজিবের দায়ের করা মামলায়, সিফাতুল বাশারের বিরুদ্ধে অর্থ হাতিয়ে নেয়া, জাল ওয়ার্ক পারমিট দেয়াসহ নানা অভিযোগের সত্যতা পায় পুলিশ। পরে মামলার অভিযোগপত্র গ্রহণ করে চলতি বছরের এপ্রিলে আসামির বিরুদ্ধের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।
এই চক্রের বিরুদ্ধে মামলা করা এমন একাধিক ভুক্তভোগীর অভিযোগ, প্রতারণার শিকার হয়ে এখনও ক্রমাগত নানাভাবে হুমকি পেয়ে আসছেন তারা।
ভুক্তভোগী আদনান আলম বলেন, ‘আমি সিফাতুল বাশার বাবু, সে আমার বন্ধু মানুষ। আমি তো সবার কাছ থেকে ছয়, সাত বা আট লাখ টাকা করে নিই। তো চার বা সাড়ে লাখ টাকার মধ্যে তোরটা হয়ে যাবে। এভাবে বলে আমাকে।’
এ ধরনের মামলায় ভুক্তভোগীদের জন্য আইন থাকলেও ক্ষতিপূরণ দেয়ার নজির নেই। মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হলে মানসিক সান্ত্বনা ছাড়া ভুক্তভোগীদের আর কিছু করার থাকে না বলে জানালেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জোর্তিময় বড়ুয়া।
তিনি বলেন, ‘পুলিশ জানতো। জেনেশুনেই তাদের বিরুদ্ধে এই পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, ভুয়া পুলিশ ক্লিয়ারেন্স নিয়েছে বলছে। পুলিশ ক্লিয়ারেন্স জাল কি জাল না সেটা তো পুলিশের নিজেদেরই জানার কথা। তারাই ইস্যু করেছে, সে যে থানা থেকে যেই ইস্যু করুক না কেন। ফলে এটা আইডেন্টিফাই করা বা আগে এটা জেনে নিয়ে মামলা করতে যাওয়া খুব বেশি কঠিন কাজ ছিল না। জেনেশুনেই হয়রানিগুলো করেছেন বা আর্থিকভাবে লাভবান হয়েই পুলিশ এখানে প্রতারণরা করেছেন।’
এমন পরিস্থিতি এসব মামলায় শেষ পর্যন্ত অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে প্রতিকারের দিকে তাকিয়ে আছেন ভুক্তভোগীরা।