ফিরে দেখা ১৪ জুলাই: আন্দোলনের অগ্রপথিক হয়ে উঠে নারী শিক্ষার্থীরা

জুলাই ক্যালেন্ডার
দেশে এখন
বিশেষ প্রতিবেদন
1

২০২৪-এর ১৪ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মোড় ঘুরে যায়। সারা রাত উত্তাল থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যায় অগ্রপথিক হয়ে উঠেছিল নারী শিক্ষার্থীরা। হলের তালা ভেঙে মিছিলে নেমে আসে তারা। ছাত্রদের সাহস হয়ে ভিসি চত্বরে অবস্থান নেয় নারীরা। সেখানে নারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ ও পতিত সরকারের বাহিনী। এতে আন্দোলন আর শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, পরিণত হয় ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে। নারী জাগরণের মধ্য দিয়ে আন্দোলন পায় নতুন মাত্রা। সেই স্লোগানের উত্তাপ এনে দেয় নতুন বাংলাদেশ, ৩৬ জুলাই।

১৪ জুলাই ২০২৪, রাত নামার আগে অব্দি ছাত্রসহ পুরো দেশ অপেক্ষায় ছিল কর্তৃত্ববাদী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনের। আশায় বুক বাধে, দাবি মেনে নেবে সরকার। কিন্তু তার বক্তব্যে ঘটে উল্টো ঘটনা, যেন আগুনে ঘি ঢেলে দিলেন শেখ হাসিনা।

সংবাদ সম্মেলনে শেষ হাসিনা বলেন, "মুক্তিযোদ্ধারা যদি না পান, তবে রাজাকারের নাতিপুতিরা কেন চাকরি পাবে?

এই বাক্য যেন ছুরি হয়ে বিঁধে বসে হাজারো শিক্ষার্থীর বুকে। পরমুহূর্তেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে শুরু হয় চাপা গুঞ্জন শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘আমরা একে অপরকে জিজ্ঞেস করছিলাম, তুমি কে? আমি কে? আমরা কি তবে রাজাকারের নাতিপুতি?’

রাত ১০টা। হলগুলো তখন বিদ্যুৎহীন। দিনভর আন্দোলনে উত্তপ্ত ঢাকার বাতাসে একটা চাপা যন্ত্রণা। এরমধ্যে হঠাৎ অন্ধকার ভেদ করে বিজয় একাত্তর হলে গর্জে উঠে স্লোগান, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার, রাজাকার’ ধ্বনিতে।

শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘হলের একপাশ থেকে কেউ বলছিলো তুমি কে আমি কে আর অপর পাশ থেকে সবাই বলছিলো রাজাকার, রাজাকার। আমরা একে অপরকে রাজাকার বলে সম্বোধন করছিলাম। অথচ এ শব্দটা বা ট্যাগ ব্যবহার করতে গেলে আগে আমাদের ভাবতে হতো৷ বাংলাদেশে যত জনগোষ্ঠী আছে শেখ হাসিনা বাদে আমরা সবাই রাজাকার। আলোতে বলতে পারিনি। কিন্তু অন্ধকারেই যেন সাহস খুঁজে পেলাম। মুহূর্তেই স্লোগান ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। যেভাবে স্লোগান দিতে বাধ্য করেছিলো যে তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি। এর বিপরীতে সবাই স্লোগান দিচ্ছিলো তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার বলে।’

ধীরে ধীরে হল থেকে বেরিয়ে আসে শিক্ষার্থীরা। মিছিলের বহর গড়ে, ইতিহাসের দিকে ধাবিত হয় এক অদম্য যাত্রা। মেয়েদের হলেও পৌঁছে যায় স্লোগানের ধ্বনি। থালা-বাটির শব্দে জেগে ওঠে নীরব রাত।

নারী শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘আমরা রোকেয়া হল থেকে সবাই বের হই। নিজেদের রাজাকার বলে স্লোগান দিয়ে সবাই বের হয়।’

সেই রাতের সাহসী নারীরা হয়ে ওঠে আন্দোলনের প্রতীক। তাদের অপ্রতিরোধ্য সাহস ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, ফেটে পড়ে দেশের অন্যান্য পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও।

পরদিন সকালে মধুর ক্যান্টিনের পাশে প্রস্তুতি নেয় ছাত্রলীগ আর বহিরাগতরা। হলে হলে ছাত্রদের আটকে রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সাহসী নারীরা অবস্থান নেয় ভিসি চত্ত্বরে। তাদের দেখে সাহস ফিরে পায় ছাত্ররাও।

তারা বলেন, ‘নারীদের অতিরিক্ত অংশগ্রহণের ফলে তারা কোন ট্যাগিং এ ফেলতে পারছিলো না। তারা ট্যাগিং দিলেও মানুষ এটা বিশ্বাস করছে না। এ কারণে তাদের ক্ষোভটা নারীদের ওপর যেয়ে পড়ে।’

নারী শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘ছাত্রলীগ অতর্কিত হামলা করে ছাত্রীদের আন্দোলনে। ওইদিন আমাদের অনেকে আহত হয়। আহতদের হাসপাতালে নিয়ে গেলে হাসপাতালের ভেতর পর্যন্ত গিয়ে হামলা করে ছাত্রলীগ আমার বোনদের ওপর।’

ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। পরিস্থিতি যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতো বদলে যেতে থাকে। এরপর এ আন্দোলন কেবল শিক্ষার্থীদের নয়, যোগ দেন অভিভাবক, শিক্ষক, শিল্পী, পেশাজীবী, শ্রমিক, দিনমজুরসহ সর্বস্তরের মানুষ। পরিণত হয় ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে। নারীদের ওপর এমন নিষ্ঠুরতা চোখে এনে দিয়েছিল সব শ্রেণি-পেশার মানুষের। সেখান থেকেই বাবা-মারাও সন্তানদের নিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন।

ইএ