অর্থনৈতিক সংকটকে পুঁজি করেই বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশটিতে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়ার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত জাতীয় অর্থনীতিকে কি শিকেয় তুলছেন তিনি?
বিশ্বজুড়ে বাণিজ্যযুদ্ধ উসকে দেয়ার পাশাপাশি সরকারি খরচ কমাতে মাত্র সাড়ে তিন মাসে ছাঁটাই করেছেন অর্ধলাখের বেশি কর্মীকে। মোট সংখ্যা দাঁড়াতে পারে এক লাখ ২৭ হাজার। শুধু এপ্রিলে মার্কিন ভূখণ্ডে সরকারি কর্মীসংখ্যা কমেছে নয় হাজার। আশির দশকের পর সবচেয়ে বেশি কর্মী ছাঁটাই করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা ইপিএ।
১২০০ পদ কমিয়ে ফেলছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ, অন্যান্য সব গোয়েন্দা সংস্থা মিলিয়ে যে সংখ্যা আরো বেশি; সবচেয়ে বড় আঘাতটি এসেছে সামাজিক নিরাপত্তা বিভাগের ওপর। প্রায় তিন হাজার পদ স্থায়ীভাবে উঠিয়ে ফেলা হয়েছে, পরিকল্পনা রয়েছে মোট সাত হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের। মোট জনবলের ১২ শতাংশ কমে যাওয়ায় আটকে আছে অনেকের প্রাপ্য ভাতা।
বাসিন্দাদের একজন বলেন, ‘আমার ছেলে প্রতিবন্ধী ভাতা পাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু এটা পেতে গিয়ে তাকে ভয়াবহ ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে।’
আরেকজন বলেন, ‘ট্রাম্প কী করছে, সেটাই বলার চেষ্টা করছি আমরা। লোকটা বদ্ধ উন্মাদ।’
বিরোধী, বিশেষ করে ডেমোক্র্যাটরা বলছে, রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের জাতীয় ব্যয় সংকোচন কর্মসূচির আওতায় ঝুঁকিতে পড়ছে যেসব প্রকল্প, আর্থিক নিরাপত্তার জন্য সাত কোটি ৩০ লাখের বেশি মার্কিনি সেসব প্রকল্পের ওপর নির্ভরশীল।
শুধু অর্থনৈতিক ঝুঁকি নয়, বাড়ছে সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার আতঙ্কও। বিভিন্ন সরকারি ও পুনর্বাসন সেবা সংস্থার তথ্য, ট্রাম্পের চলতি মেয়াদের প্রথম ১শ' দিন পার হতে হতে বাড়ছে দেশ ছেড়ে ইউরোপে স্থায়ী হতে চাওয়া মার্কিনির সংখ্যাও।
মার্কিনিদের একজন বলেন, ‘আমরা এই দেশকে ভালোবাসি। কিন্তু বর্তমান যে রূপ নিয়েছে দেশটি, সেটা আমরা পছন্দ করছি না। যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তিনি জিতেছেন, সেটাই আমাদের দেশত্যাগের বিষয়ে ভাবতে বাধ্য করেছে। যখন আপনার অস্তিত্বের ওপর আঘাত আসে, তখন ক্ষোভ-হতাশার মতো ব্যক্তিগত অনুভূতি তো তৈরি হয়ই, তার ওপর আপনার পরিচয়ও যদি রাজনৈতিক গুটি হয়ে যায়!’
কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের নতুন দেশে স্থায়ী হতে সাহায্য করা প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাক্সিট বলছে, ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর তাদের ওয়েবসাইটে ট্রাফিক বেড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি; সদস্যপদ বেড়েছে ২৯০ শতাংশ, যারা প্রতি মাসে খরচ করছেন ১৭ ডলার করে।
পর্তুগালের ব্ল্যাক্সিট গ্লোবালের প্রতিষ্ঠাতা ক্রিশান রাইট বলেন, ‘ট্রাম্পের পুনঃনির্বাচনে আমি আশ্বস্ত হয়েছি যে আমি সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম। কারণ এই সময়ে এসে এটা একদম স্পষ্ট যে প্রথম মেয়াদে তিনি ব্যর্থ হলেও, মহামারি সামলাতে নিজের দুর্বলতার পরিচয় দিলেও, বিভক্তি সৃষ্টিকারী কথাবার্তা বললেও তাকেই ফিরিয়ে আনতে চেয়েছে নির্বাচকমণ্ডলী। আমি মনে করি যে এখনও ইউরোপের দেশগুলোতে ধেয়ে আসছে আমেরিকানরা।’
পর্তুগাল, স্পেন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে স্থায়ী হতে আগ্রহী তারা। আয়ারল্যান্ডের পররাষ্ট্র বিভাগের তথ্য, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে আইরিশ পাসপোর্টপ্রত্যাশী মার্কিন আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল এক দশকে সর্বোচ্চ।
জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে জমা পড়েছে ৪৩শ' আবেদন, যা গেলো বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬০ শতাংশ বেশি। ২০২৫-এ মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে প্রায় ২২শ' মার্কিনিকে দীর্ঘমেয়াদি ভিসা দিয়েছে ফরাসি সরকার, যা গত বছর একই সময়ে ছিল ১ হাজার ৮০০ এর কম।
যুক্তরাজ্যেও জানুয়ারি থেকে তিন মাসে ব্রিটিশ পাসপোর্ট চেয়ে আবেদন করেছেন ১ হাজার ৭০০ এর বেশি মার্কিন নাগরিক, যা গেলো দুই দশকের যেকোনো প্রান্তিকের তুলনায় অনেক বেশি।
নাগরিকদের একজন বলেন, ‘আমরা খুশি যে আমরা এখানে আছি। এখানে বেশি নিরাপদ বোধ করছি। আমরা মনে করি যে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় এখানে, যুক্তরাজ্য আমাদের অধিকার রক্ষায় এগিয়ে বেশি।’
মূলত ট্রাম্পের ভয়েই যুক্তরাষ্ট্র ছাড়তে চান অনেক মার্কিন নাগরিক। অভিবাসনে সহযোগিতাকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ওয়েবসাইট বলছে, রাজনৈতিক বিভক্তি আর আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতাও মার্কিন নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে অন্যান্য দেশে স্থায়ী হতে চাওয়ার বড় কারণ।