শহিদের কাছে মৃত্যু যে কত তুচ্ছ, তার জ্বলন্ত প্রমাণ মুগ্ধ। ফ্যাসিবাদ হটাতে বিক্ষোভ-মিছিল-প্রতিবাদের মানুষদের পানি বিলিয়ে বসে থাকার পর পুলিশের ধাওয়ায় যখন সবাই ছুটছে এদিক ওদিক। তখনও পুলিশের গতিবিধি লক্ষ্য করছিলো মুগ্ধ। মাথা তুলে তাকাতেই পুলিশের একটি গুলি নিস্তেজ করে দেয় মুগ্ধকে।
মুগ্ধের বন্ধু মো. জাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘আশিক আর মুগ্ধ পানি খাওয়াচ্ছিলো, পেছনে ভিডিও করছিলাম আমি। এটা করার পরই রাস্তার ডিভাইডারের মধ্যে গিয়ে আমরা বসছি। সামনে পুলিশ ছিল, তারা একেবারের বরাবর আমাদের দিকেই আসছিল। মুগ্ধ মাথা উঁচু করে দেখছিল যে পুলিশ কতদূর আসছে। তখনই একটা গুলি এসে মুগ্ধের কপালে লেগে কান দিয়ে বের হইছে।’
রণক্ষেত্রে কখনও পানি হাতে, কখনও আহতদের জন্য আরোগ্যের হৃদয় হয়ে, কখনও স্লোগানে, কখনও পুলিশের টিয়ারসেল দমাতে সবাইকে নিয়ে আগুনের পাশে জড় হয়েছে মুগ্ধ। ঘর, ক্যাম্পাস, রণক্ষেত্র সবখানেই নেতৃত্ব যেন তার পোষ মানা। যে নেতৃত্ব মৃত্যুর শেষ ক্ষণ পর্যন্ত মানবিকতার বীজ বুনে গেছে।
শহীদ মীর মুগ্ধের ভাই মীর স্নিগ্ধ বলেন, ‘যখনই কোনো জায়গায় যেত, ও সে জায়গায় নেতৃত্বের ভূমিকায় চলে আসতো। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ও একজন কনভেইনার ছিল, স্কাউটিং করতো। ২৮ তারিখেও সে সেখানে স্লোগানরত অবস্থায় ছিল, আহতদের সেবা করার অবস্থায় ছিল।’
আরও পড়ুন:
মুগ্ধের মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশি একা হয়েছে একই চেহারার জমজ ভাই মীর স্নিগ্ধ। যে ঘর ও বিছানায় বছরের পর বছর কেটেছে একসঙ্গে সেটি এখন ছন্দহীন। মৃত্যুর এক বছর পরও ঘুমের ঘোরে মুগ্ধকে খুঁজে ফেরে মীর স্নিগ্ধ। সম্পর্কের নিখাদ গভীরতার অনন্য প্রমাণ এই যে, মুগ্ধ ও সিগ্ধকে পার্থক্যকারী চোখের নিচের তিল যা মুগ্ধের মৃত্যুর পর সিগ্ধের চোখের নিচেও উঠতে শুরু করেছে।
মীর স্নিগ্ধ বলেন, ‘এত জোরে জোরে কথা বলতো যে, ওর কথায় মাঝেমধ্যে আমার ঘুম ভেঙে যেত। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় ওই সময়েই যখন ঘুমের মধ্যে মনে হয় যে, পাশে মুগ্ধ কথা বলছে কিন্তু ঘুম ভাঙার পর দেখি মুগ্ধ আর পাশে নাই।’
পুরো পরিবার মাতিয়ে রাখা মুগ্ধ ছিলো একাধিক গুণের অধিকারী যা তার পরিবারে এখন শোভা পাচ্ছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তার অসাধারণ সব গুণের স্মৃতিচারণ করেছেন।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মো. আজমল হুদা বলেন, ‘ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করার জন্য ও রাতে দেরিতে ঘুমাতো। আমার সকালেই ক্লাস থাকতো। সাধারণত ৮টায় ক্লাস থাকে। ও ক্লাসে একটু দেরি করে আসতো। আমি মাঝেমধ্যে ওকে একটু বকাঝকা করতাম। বকি আর যাই করি না কেন, ও কখনোই মন খারাপ করেনি। মলিন মুখ ওর কখনও ছিল না।’
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. সরদার ফিরোজ আহমেদ বলেন, ‘বিভাগের যত প্রোগ্রাম হয়, প্রতিটি কাজে, প্রোগ্রামের জন্য সে ভালো একজন আয়োজক ছিল।’
আরও পড়ুন:
তার স্মৃতি ধরে রাখতে ক্যাম্পাসের প্রধান ফটক থেকে শুরু করে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিষয়ক সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. মো. নাজমুস সাদাত বলেন, ‘খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের নাম শহিদ মীর মুগ্ধ তোরণ করা হয়েছে। এছাড়া খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণাধীন টিএসসির সামনেও মুগ্ধ স্মৃতিস্তম্ভের পরিকল্পনা রয়েছে। গণিত অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, শহিদ মীর মুগ্ধের স্মৃতিতে তারা স্কলারশিপ দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে।’
শহিদ মুগ্ধ এতটাই মুগ্ধতা ছড়িয়েছিল, চব্বিশের ১৯ জুলাই মুগ্ধের দাফনে অংশ নেয়ার তিন ঘণ্টা পর একইভাবে গুলি খেয়ে শহিদ হন রেদওয়ান শরীফ জয়। বিরল এই স্মৃতি ধরে রাখতে মুগ্ধের পাশের কবরেই সমাহিত করা হয়েছে শহিদ জয়কে। সতীর্থদের চাওয়া শহিদদের রক্ত যেন বৃথা না যায়।