গাজীপুরে গর্জে ওঠে তরুণ প্রজন্ম, দাঁড়িয়েছিলেন ঢাল হয়ে

গণঅভ্যুত্থানের সময় উত্তাল গাজীপুর
দেশে এখন
বিশেষ প্রতিবেদন
1

চব্বিশের জুলাইয়ে গাজীপুরের রাজপথে গর্জে উঠে তরুণ প্রজন্ম। বুকের তাজা রক্ত আর সাহসিকতার আগুনে সেদিন ছিন্নভিন্ন হয়েছিল স্বৈরতন্ত্রের দেড় দশকের ক্ষমতার মসনদ। টিয়ারশেল, রাবার বুলেট, জলকামান কিছুই থামাতে পারেনি তাদের। বছর পেরিয়ে আবারও এসেছে রক্তাক্ত জুলাই, প্রশ্ন উঠেছে- যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নে রাজপথে রক্ত ঝরেছিল, সেই স্বপ্ন কতটুকু পূরণ হলো?

সময়টা ছিল তারুণ্যভরা স্লোগানের। সেই স্লোগান কাঁপিয়ে দেয় শাসকের দেড় দশকের ক্ষমতার মসনদ। শহর থেকে গ্রাম, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাড়ার স্কুল। আধিপত্যবাদের থাবা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় জেগে উঠেছিল ছাত্র-জনতা।

গাজীপুরের ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট) প্রাঙ্গণকে বলা হয় জুলাই আন্দোলনের সূতিকাগার। ১০ জুলাই ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির মাধ্যমে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে শরিক হয়। এরপর থেকেই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে শহরের অলিগলি, উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো গাজীপুর।

১৬ জুলাই দুপুরে শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে গাজীপুরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা জড়ো হন ডুয়েট প্রাঙ্গণে। একসময় তা রূপ নেয় জনস্রোতে। পরে শিববাড়ি মোড় হয়ে চান্দনা চৌরাস্তা অভিমুখে শুরু হয় বিক্ষোভ মিছিল।

জুলাই যোদ্ধা মো. শাহজাহান চৌধুরী বলেন, ‘যেন আমাদের জনসমাগমটা শুধু ডুয়েট কেন্দ্রিক না হয়। এটা যেন পুরো গাজীপুরকেই একসঙ্গে করা যায়, এটা ছিল আমাদের মূল টার্গেট। এখান থেকে শুরু হচ্ছে এখানেই যেন শেষ না হয়।’

তানভীর হাসান রামিম বলেন, ‘চৌরাস্তা ব্লক করার জন্য আমরা ১৬ তারিখ দুপুর ২টা থেকে জড়ো হতে থাকি ডুয়েট প্রাঙ্গণে। তখন গাজীপুরের বেশ কয়েকটি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে।’

আন্দোলনের সময় পুলিশ সবচেয়ে বেশি বলপ্রয়োগ করে শিববাড়ি এলাকায়। ১৯ জুলাই শিববাড়ি মোড়ে অবস্থান নেয় পুলিশের বিপুল সংখ্যক সদস্য। জয়দেবপুর রেল গেইটের দিকে অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আর শিববাড়ি বাসস্ট্যান্ডের ওপাশে পুলিশের গুলির মুখে বুক পেতে দাঁড়ায় ছাত্র-জনতা।

‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’ এই স্লোগান হৃদয়ে ধারণ করে শিক্ষার্থীরা সেদিন রুখে দাঁড়ায়। টিয়ারশেলের ধোঁয়া, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট আর জলকামানেও দমানো যায়নি এই তারুণ্যের প্রতিবাদ। মুহুর্মুহু গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা।

আন্দোলনে অংশ নেয়া মাহরাব হোসেন বলেন, ‘পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা শুরু করে আমাদের শিক্ষার্থীদের অকাতরে আহত করা শুরু করে দেয়। আমরা আহত শিক্ষার্থীদের টেনে টেনে যত সরাচ্ছি, তত তারা আরও এগিয়ে আসছে। আরও দ্বিগুণ উৎসাহে গুলি করে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন আমাদের মেরে ফেলার জন্য তারা মরিয়া হয়ে উঠছে।’

মো. ইশহাক পিকু নামের একজন বলেন, ‘কেউ এখানে বায়তুন নূর গলিতে অবস্থান নেয়, কেউ মুন্সিপারা গলিতে অবস্থান নেয়। আর কেউ আমাদের ডুয়েট অভিমুখী রোডে অবস্থান নেয়। সেই মুহূর্তে একটা নারকীয় তাণ্ডব আমরা দেখতে পাই।’

আন্দোলন দমাতে ২০ জুলাই থেকে সারাদেশে জারি হয় কারফিউ। সেদিন সকালে কারফিউ ভেঙে টঙ্গীর রাজপথ দখলে নেয় আন্দোলনকারীরা। দুপুরে আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্ষমতাসীন দলের সশস্ত্র নেতাকর্মীরা। শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, সংঘর্ষ।

সকাল থেকেই আন্দোলনকারীদের প্রতিরোধে কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে থানাগুলো। সেই সুযোগে আন্দোলনকারীরা দখলে নেয় টঙ্গীর রাজপথ। বিভিন্ন স্থানে দলীয় ক্যাডারদের সশস্ত্র আক্রমণে হতাহতের ঘটনা ঘটে।

আন্দোলনের অন্তিম লগ্নে সবচেয়ে নির্মম ঘটনা ঘটে গাজীপুরের কোনাবাড়িতে। ৫ আগস্ট, শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবরে বিজয় মিছিলে অংশ নেয় কলেজ ছাত্র হৃদয়। এক ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, আটকের পর হৃদয়কে ঘিরে ধরে কিছু পুলিশ। এরপর হঠাৎ গুলির শব্দ, মাটিতে লুটিয়ে পড়ে হৃদয়। কিছু পুলিশ সদস্য তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় নিয়ে যায়। বছর পেরিয়ে গেলেও তার পরিবার আজও খুঁজে পায়নি হৃদয়ের মরদেহ।

হৃদয়ের মা বলেন, ‘আমার ছেলেকে যারা মেরেছে তাদের যেন উচিত বিচার হয়।’

হৃদয়ের বোন বলেন, ‘ভাইয়ের কোনো খোঁজ-খবরই পাইনি। ভাইকে যেন এমন করে মারলো, কোথায় রাখলো? কী করলো? তার কোনো তদন্ত খোঁজই পাচ্ছি না।’

এই যে এত ত্যাগ, এত প্রাণের বিনিময়ে মানুষ পেয়েছিল নতুন এক মুক্তির স্বাদ। তবুও এক বছর পর প্রশ্ন রয়ে গেছে-বিপ্লবের সেই আকাঙ্ক্ষা কতটা পূরণ হলো?

আন্দোলনকারীদের মধ্যে একজন বলেন, ‘যারা নিজেদেরে মুখ লুকিয়ে রেখেছিল তারা ৫ তারিখের পর নিজেদের কর্তৃত্ব হাসিলের জন্য মাঠে নামে। তারাই আজকে নিজেদের নের্তৃত্বস্থানকে তুলে ধরে নিজেদের স্বার্থ আদায়ের জন্য নিজেদের ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার করছে। এক্ষেত্রে জুলাইয়ের যারা মেইন বিপ্লবী তারা এ অবমূল্যায়নের কাতারে পড়ে যাচ্ছে।’

অন্য একজন বলেন, ‘অনেকদিন থেকেই সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে সবাই জুলাই সনদের কথা বলছে। জুলাই সনদের ব্যাপারে বড় বড় রাজনৈতিক দল সবাই কিন্তু একমত না। এ বিষয়ে যদি একমত না হয় তাহলে আমরা কীভাবে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করব?’

জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, জুলাই আন্দোলনে গাজীপুরে গেজেটভুক্ত শহীদের সংখ্যা ১৮ জন। এখনও নির্ধারণ হয়নি আহতের সংখ্যা। এসব ঘটনায় গাজীপুর জেলার বিভিন্ন থানায় দায়ের করা হয়েছে ২৪টি মামলা। আর মেট্রোপলিটন এলাকার আট থানায় মামলা হয়েছে ৪৫টি। যার মধ্যে ১৮টিই হত্যা মামলা। আর এসব হত্যা মামলায় অধিকাংশেই প্রধান আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।

এসএস