চব্বিশের জুলাইয়ের শুরুতে সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যাপক অংশগ্রহণের এক পর্যায় সাধারণত শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগ সশস্ত্র হামলা চালায়।
১৫ জুলাই দিনভর ছাত্রলীগ, যুবলীগের আক্রমণ ও প্রশাসনের সাঁড়াশি অভিযানের মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে যায়। এমন অবস্থায় আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে তৈরি হয় সংশয়। কিন্তু সন্ধ্যা গড়াতেই হলপাড়া থেকে ছাত্রদের প্রতিরোধ শুরু হয়, যার সূত্রপাত ঘটেছিলো বিজ্ঞান অনুষদ ও চানখারপুল এলাকা থেকে। এই প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে দুটি ছাত্রসংগঠন-ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির।
ঢাবি ছাত্রদলের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মো. মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘ওদের হাতে অনেক অস্ত্র ছিল কিন্তু আমাদের হাতে শুধু ইটের টুকরা ছিল। আর বুক ভরা সাহস ছিল।’
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রশিবিরের সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক শফিকুল ইসলাম সাইফুল বলেন, ‘বার বার ছাত্রলীগ আমাদেরকে হামলা করতে চাচ্ছিলো। পরে যখন আমরা ধাওয়া দেই তখন তারা পিছু হটতে শুরু করে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরার অবরুদ্ধ হওয়ায় পার্শ্ববর্তী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ছুটে আসে শিবির ও ছাত্রদলের কর্মীরা। সেদিনকার চানখারপুর এলাকার বিভিন্ন ভিডিও বিশ্লেষণ করলে এর সত্যতা মিলে।
ফুটেজ বিশ্লেষণে দেখা যায় নাহিদ আসিফের সাথে ছাত্রশিবিরের নেতাদের উপস্থিতি। কেন্দ্রের নির্দেশেই চানখারপুলে অবস্থান নিয়েছিলেন বলে জানান ঢাকা মহানগর দক্ষিণের এই শিবির নেতা।
শফিকুল ইসলাম সাইফুল বলেন, ‘১৫ তারিখ আমাদের নির্দেশ আসে যে ছাত্র ভাইরা হলে আটকা পড়ে তাদের দ্রুত উদ্ধার করতে হবে। এরপর সবাইকে ধাওয়া দিলে তার পিছু হটতে শুরু করে।’
জুলাই নিয়ে লেখা উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার ‘মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’ বইতেও উঠে আসে ছাত্রদল ও শিবিরের প্রতিরোধের ঘটনা। শিবির নেতা সাদিক কাইয়ুমের সাথে সাহায্যের জন্য যোগাযোগ করে তৎকালীন সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ।
ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রকাশনা সম্পাদক সাদিক কাইয়ুম বলেন, ‘ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা যখন আমাদের ভাই বোনদের মেরে যখন রক্তাক্ত করেছিল তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এই ছাত্রলীগদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করতে হবে। তখন আমি আসিফ মাহমুদকে কল করি এবং একই সঙ্গে হাসনাত ও মাহফুজ আলমের সঙ্গে আমার কথা হয়। তখন তারা বুয়েটের ক্যাম্পাসে ছিল। আমি তাদেরকে প্রস্তাব দেই আমরা সন্ধ্যার দিকে চানখারপুলে একত্রিত হবো। এছাড়া যতলোক লাগে আমরা ম্যানেজ করবো। এখানে একত্রিত হয়ে সায়েন্সের তিনটা হলকে সেন্টার করে। আমরা ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের ক্যাম্পাস ছাড়া করবো।’
একই সময় আসিফ মাহমুদের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় ছাত্রদল নেতা মাসুম বিল্লাহর সাথে। ১৫ তারিখ সন্ধ্যায় ধারণ করা শহিদুল্লাহ হলের সামনের এই ভিডিওটিতে দেখা যায় নেতাকর্মীদের ঘিরে স্লোগান দিচ্ছেন ঢাবি ছাত্রদলের এই নেতা। তার নেতৃত্বেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান হল ও চানখারপুলে জড়ো হয় ছাত্রদলের কর্মীরা।
ঢাবি ছাত্রদলের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মো. মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘আসিফ বলতেছিল আপনাদের কাছে কিছু আছে। তখন আমি বললাম আমাদের অনেকগুলো বডি আছে এতকিছু লাগে না। বলার পরে দেখলাম আসিফও উজ্জবিত।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের আরেক নেতা আবিদুল ইসলাম খানের বক্তব্যেও উঠে আসে পুরো জুলাই আগস্ট জুড়ে ছাত্রদলের সক্রিয় থাকার কথা।
আবিদুল ইসলাম খান বলেন, ‘যেখানে বিক্ষোভ হবে তার থেকে আমরা নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করবো। কারণ আমরা যারা সিনিয়র আছি তাদেরকে সবাই আসলে চিনতো। ফলে আমাদেরকে দিয়ে আন্দোলনকে নষ্ট করে দেয়ার সম্ভাবনা আছে।’
এই হামলার জেরেই নেপথ্যে থেকে সামনে চলে আসে শিবির ও ছাত্রদল। এর কিছুদিন পর কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রথম সারির নেতারা গ্রেপ্তার হলে আন্দোলনকে বাঁচিয়ে রাখে মূলত ছাত্রসংগঠনগুলোই।