জলের সাথেই এখানে এগিয়ে চলে জীবনের গল্প। সুনামগঞ্জের হাওরের বুক চিরে বিশম্ভরপুর উপজেলা। কখনো অথৈ পানি আবার কখনওবা পানির সংকটকে সঙ্গী করেই চলে এখানকার জীবিকা। ভরা বর্ষায় যখন পানিতে টইটুম্বুর, ঠিক উল্টো চিত্র গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে। বিশাল জলরাশির মাঝেও পানি সংকট। চৌচির ফসলের মাঠ। শুধু তাই নয়, সংকট পরে বিশুদ্ধ খাবার পানিরও।
সুপেয় পানি যোগাতে শত শত পরিবারের নিত্যদিনের সংগ্রাম এই অঞ্চলে। প্রতিদিন দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পানি সংগ্রহ যেন নারীদের দৈনন্দিন রুটিন।
নারীদের একজন বলেন, ‘আমরা যে যেখান থেকে পায় সেখান থেকেই পানি নিই।’
আরেকজন বলেন, ‘এক কলস পানি নেই খাওয়ার জন্য। এ ছাড়া পুকুর থেকে আমরা গোসল করি। এখন তো কিছু করার নেই।’
ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় কয়েক বছর ধরেই টিউবওয়েলগুলোতে পানির দেখা নেই। সুপেয় পানির অভাবে ব্যাঘাত ঘটে সাংসারিক কাজে। নারীদের ভুগতে হয় চর্মরোগ, ডায়রিয়াসহ নানা শারীরিক সমস্যায়। এমনকি দূর-দূরান্তে পানি সংগ্রহে গিয়ে হতে হয় হেনস্তার শিকার।
নারীদের আরেকজন বলেন, ‘পানি আনতে আগে দূর-দূরান্তে যেত হতো। ওই পানি ব্যবহার করলে আবার অসুখ হতো।’
আরেকজন বলেন, ‘পানি আনতে আগে কষ্ট হতো। হয়রানির শিকার হতে হতো তবে এখন তা হয় না।’
এ অঞ্চলের পানির সংকট দূর করতে চলছে কমিউনিটিভিত্তিক জলবায়ু সহনশীলতা ও নারীর ক্ষমতায়ন কর্মসূচি। যার আওতায় সোলার প্যানেলের সহায়তায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং পদ্ধতিতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার এই প্রকল্পে সুপেয় পানির সহায়তা পাচ্ছে প্রায় অর্ধশত পরিবার।
বাসিন্দাদের একজন বলেন, ‘৪০০ ঘরের মতো আছে। এখন আমরা শান্তিতে আছি। পানির কষ্ট নেই।’
আরেকজন বলেন, ‘সবাই এখন পানি খেতে পারছেন। এখন ডিপের পানি খাচ্ছি।’
প্রকল্প কর্মকর্তারা বলছেন, স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় ভবিষ্যতে আরো বেশি মানুষকে পানির সুবিধা দেয়ার প্রত্যাশা তাদের।
সুনামগঞ্জ বিশ্বম্ভরপুর ক্রিয়া প্রকল্পের প্রজেক্ট ম্যানেজার বদরুজ্জামান রনি বলেন, ‘নিরাপদ বা বিশুদ্ধ পানির খুবই অভাব। আর নারী ও পানি একে অপরের সাথে জড়িত। এখানে ৪৪টি পরিবারের পাশাপাশি অন্য জায়গা থেকে আরো ২০-২৫টি পরিবার।’
সুনামগঞ্জ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর তথ্যমতে, জেলায় ১২টি উপজেলায় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে হস্তচালিত নলকূপ রয়েছে ২৪ হাজারের মতো। তবে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অকেজো প্রায় ১০ হাজার নলকূপ।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ খাদেমুল ইসলাম বলেন, ‘এই সিজনে জনবল কম পাওয়া যাচ্ছে। তারপরে আমরা কাজ শুরু করে দিবো। এছাড়া আমাদের যে রাজস্বের সহায়ক টিউবওয়েল ১ হাজার ৪৪টির মতো রয়েছে সেইগুলোর কাজও চলমান।’
সুপেয় পানির সংকট ঘিরে নারীদের দুর্ভোগ-কষ্ট দূরীকরণে বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালনা করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো। তবে দীর্ঘমেয়াদে পানির সংকট ও প্রান্তিক নারীদের স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানে স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে যৌথ প্রয়াসে কাজ করার তাগিদ তাদের।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, ‘নারী বিষয় আমরা খুব বিশেষভাবে দেখি। যেকোনো ক্রাইসিসে নারীরাই প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমরা একটা মডেল তৈরি করি সেটা সরকার নিয়ে আরো ব্যাপকভাবে করবে।’
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে প্রান্তিক অঞ্চলের পানি সংকটের প্রভাব পড়ছে নারীদের উপর। সমাধানে শুধু প্রকল্পভিত্তিক নয়, বরং স্থায়ী বন্দোবস্তের দাবি প্রান্তজনদের।