জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ‘বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ’ জারির পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক
দেশে এখন
বিশেষ প্রতিবেদন
0

বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোতে অধ্যাদেশ দিয়ে সাংবিধানিক সংশোধনী সম্ভব নয়। আবার যেকোনো অধ্যাদেশ বাতিল করে দিতে পারে উচ্চ আদালত কিংবা পরবর্তী সংসদ। তাই জুলাই সনদের আইনি বাধ্যবাধকতা নিশ্চিতে ‘বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ’ জারির পরামর্শ দিয়েছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, রাজনৈতিক ঐকমত্যের পাশাপাশি গণভোটে পাশ হলে পরবর্তী সংসদ জুলাই সনদ মানতে বাধ্য। তখন আদালতের দায়িত্ব হবে নতুন সংবিধান রক্ষা করা। তবে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণপরিষদ কিংবা সংস্কার পরিষদ সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি বলে মনে করছেন অনেকে।

রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ছয় মাস আলোচনার পর ৮৪টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্য হলেও এর বাস্তবায়ন নিয়ে ভিন্ন অবস্থানে দলগুলো। বিএনপি চায়, পরবর্তী সংসদ, জামায়াত চায় গণভোট এবং এনসিপির দাবি গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে সাংবিধানিক সংস্কার করতে।

রাজনৈতিক দলগুলোর এ পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথ খুঁজতে গত দুই সপ্তাহে কয়েক দফা বিশেষজ্ঞের সঙ্গে বৈঠক করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তারা বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ দিয়ে সনদ বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ বিদ্যমান সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধানের কোনো বিধান পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।

বিশেষ সাংবিধানিক অধ্যাদেশ প্রসঙ্গে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা আইন।

রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাউয়ুম বলেন, ‘জুলাই চার্টারে অনেক বিষয় আছে যেটা সংবিধানকে টাচ করে। সেটি তো অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যাবে না। সেক্ষেত্রে প্রশ্নটা জাগে যে, বিদ্যমান সংবিধানের কাঠামোর বাইরে গিয়ে জুলাই চার্টারকে বাস্তবায়ন করার জন্য আমরা কোনো বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের কথা চিন্তা করতে পারি কি না। বিষয়টি কিন্তু এভাবেই এসেছে। আমি মনে করি এটা সম্ভব।’

সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক বলেন, ‘আসলে এখানকার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতাটাকে একটা আইনে পরিণত করা। এমনিতে অনেকের মধ্যে সন্দেহ আছে যে আসলে সমস্ত সমঝোতার কোনো ধরনের মূল্য থাকে না। কিন্তু যখনই টা কটা নে পরিণত হয় এবং সবাই মিলে এ আইনটাকে যদি মেনে নেয় তাহলে সেটার গ্রহণযোগ্যতারও থাকবে, এটা ফেলে দেয়ার সম্ভাবনাটাও কমবে।’

আরও পড়ুন:

তবে এ বিশেষ আদেশকে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বলে মনে করে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ জানান, সংবিধান স্থগিত থাকলে রাষ্ট্র পরিচলানার জন্য সাংবিধানিক আদেশের প্রয়োজন হয়। যেহেতু সংবিধান অনুযায়ী দেশ পরিচালিত হচ্ছে, তাই বিশেষ আদেশের প্রয়োজন নেই।

সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমদের তো একটা সংবিধান এখন আছে। যেটি চালু আছে, স্থগিত করা হয়নি। এ সংবিধান অনুযায়ীই সরকার শপথ নিয়েছে। সংবিধান অনযায়ীই বর্তমান জুডিশিয়ারি চলছে, প্রশাসন চলছে, সবকিছুই চলছে। এ অবস্থায় সংবিধানিক অর্ডার ইস্যু করারই তো কোনো সুযোগ নেই, প্রয়োজনীয়তাও নেই। এমন না যে, এ সংবিধানের বিধানগুলো যেগুলো সংশোধিত হবে সেগুলো আজকেই ইন অ্যাকশনে না থাকলে রাষ্ট্র চলছে না। এমন কোনো পরিস্থিতি তো নাই। রাষ্ট্র চলছে, সাংবিধানিকভাবেই চলছে।’

তবে অতীতের অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে ঝুঁকির আশঙ্কা থেকেই বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের দাবি উঠছে, যা করা হলে আদালত সহজে বাতিল করতে পারবে না।

হাসনাত কাউয়ুম বলেন, ‘এখানকার অ্যাফিলিয়েট ডিভিশনের কাছে এটা চায়, তারা যদি বলে এটা ১০৬ অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকারের কথা বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার বলে তো আমাদের কিছু নাই। অন্তর্বর্তী সরকারকে যেভাবে বলছে। একইরকম যদি বলে যে আপনারা করে নিতে পারেন তাহলে আইনটা আরও শক্তিশালী হবে।’

আরও পড়ুন:

সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য ইমরান হোসাইন বলেন, ‘সিরিয়াতে কী হলো? বিপ্লবের পরে যে বিপ্লবী সরকার হলো তারা অন্তর্বর্তী সংবিধান সই করে ওরা জারি করে দিলো তো। বিপ্লবের পর যে সরকার গঠিত হয় সেটা কিন্তু জনগণের অভিপ্রায়ের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই গঠিত হয়। তখন কিন্তু তারা পুরাতন কোনো আইনি বা সংবিধানিক কাঠামোতে তারা আবদ্ধ থাকতে বাধ্য নয়। সরকার যদি মনে করে, আমরা জনগণের ইচ্ছা দ্বারা গঠিত এবং আমরাই সিদ্ধান্ত নেবো যে, আমাদের পরবর্তী সাংবিধানিক কাঠামো কী হবে।’

সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের পাশাপাশি জনগণের মতামত যাচাইয়ে গণভোট জরুরি বলে মনে করেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের এ সদস্য।

ইমরান হোসাইন বলেন, ‘এ জুলাই সনদের মাধ্যমে কিন্তু আমরা সংবিধানের কিছু মৌলিক সংশোধন আনার চেষ্টা করছি বা মৌলিক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি। মৌলিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আসলে জনসমর্থন যাচাই করা খুবই জরুরি।’

আরও পড়ুন:

হাসনাত কাউয়ুম মনে করেন, ক্ষুদ্র অর্থে এ প্রক্রিয়া গণপরিষদের প্রাথমিক ধাপ। তবে গণপরিষদ নয় বরং সংস্কার পরিষদ নির্বাচনের দাবি রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের।

হাসনাত কাউয়ুম বলেন, ‘এই নির্বাচনের মধ্যে দুইটা ক্ষমতা নেয়া যায় জনগণের কাছ থেকে, দুইটা ম্যান্ডেট চাওয়া যেতে পারে। এক নম্বর হচ্ছে- আমরা জাতীয় পরিষদের সদস্য হবো। দুই নম্বর হচ্ছে- আমরা সংবিধান সংস্কার পরিষদেরও সদস্য হবো। তাহলে প্রথমেই এরা তিন মাসের মধ্যে সংবিধান পরিবর্তন করে নেবে। তারপর তারা সরকার গঠন করবে।’

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য বিশেষ আইন ঘোষণার পাশাপাশি সংবিধান পরিবর্তনের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্যে আসতে হবে। শিগগিরি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তৃতীয় দফায় আলোচনা শুরু করবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

এসএস