ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যত চুক্তি

১৯৭২ সালের ২ জুলাই ইন্দিরা গান্ধী ও জেড এ ভুট্টো সিমলা চুক্তি স্বাক্ষর করেন
এশিয়া
বিদেশে এখন
0

পেহেলগাম হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে ঐতিহাসিক সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি বাতিল করেছে ভারত। এরই প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তি স্থগিত করেছে। ১৯৭২ সালের ২ জুলাই তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে এই চুক্তি সই হয়েছিল। মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এই চুক্তিই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনে। চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল, কোনো পক্ষই একতরফাভাবে কোনো পদক্ষেপ নেবে না। দুই দেশের মধ্যে বিরোধ দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধান করা হবে।

উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসানে, দেশভাগের পর থেকে কূটনৈতিক থেকে শুরু করে সংস্কৃতি পর্যন্ত, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাকিস্তান ও ভারতের সম্পর্ক বারবার সংবেদনশীল অবস্থায় ছিল। দ্বিপাক্ষিক চুক্তিও এর ব্যতিক্রম নয়। দুদেশের অস্থিরতা রোধে ১৯৪৭ সালের পর থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বেশ কিছু চুক্তি সম্পাদিত হয়।

সেসব গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক চুক্তি এবং তাদের বর্তমান বিষয়ের বিস্তারিত থাকছে আজকের এপ প্রতিবেদনে।

নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি

১৯৫০ সালের ২ এপ্রিলে নয়াদিল্লিতে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যা নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি নামে পরিচিত। এর আরেক নাম দিল্লি চুক্তি। দেশভাগের পর যখন উভয় দেশেই সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তিতে বলা হয় দুদেশের সরকারই সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষার বিষয়ে একে অপরের কাছে জবাবদিহি করবে। চুক্তির ধারায় চলাচলের স্বাধীনতা, কর্মসংস্থানে বৈষম্যহীনতা এবং এর বাস্তবায়ন তদারকির জন্য উভয় দেশে একটি সংখ্যালঘু কমিশন গঠনও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

সিন্ধু নদের পানি চুক্তি

১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত এই চুক্তিতে সিন্ধু নদীর পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রতিবেশি দেশের অধিকার ও বাধ্যবাধকতা এবং সীমাবদ্ধতা নির্ধারণ করা হয়েছিল। ছয় বছর আলোচনার পর নেহেরু এবং প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান এতে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিতে পশ্চিমাঞ্চলীয় নদী- সিন্ধু, ঝিলাম এবং চেনাবের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তানকে এবং পূর্বাঞ্চলীয় নদী- রবি, বিয়াস এবং শতদ্রেুর নিয়ন্ত্রণ ভারতকে দেয়া হয়েছিল। এই চুক্তির মাধ্যমে বছরের পর বছর ধরে অসংখ্য বিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পত্তি করা হয়েছে।

সিমলা চুক্তি

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে এই চুক্তি হয়। এর স্বাক্ষরকারীরা ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং ইন্দিরা গান্ধী। কাশ্মীর নিয়ে এই চুক্তিতে শর্ত ছিল দুদেশের কোনো পক্ষই একতরফাভাবে কোনো পদক্ষেপ নেবে না, দুই দেশের মধ্যে বিরোধ দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধান করা হবে এবং লাইন অব কন্ট্রোল হবে পাকিস্তান ও ভারতের নিয়ন্ত্রণ রেখা।

তবে পাকিস্তানের দাবি, ভারত ২০১৯ সালে সিমলা চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। একতরফাভাবে চুক্তির ৩৭০ ধারা বাতিল করে জম্মু ও কাশ্মীরের উপর কেন্দ্রের শাসন জারি করে। এর ফলে বহিরাগতরা কাশ্মীরে বসবাসের সুযোগ এবং সম্পত্তি কেনার অধিকার পায়। যার ফলে উপত্যকার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার পরিবর্তন ঘটেছে।

ধর্মীয় উপাসনালয় পরিদর্শনের প্রোটোকল

এই প্রোটোকল একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, যা ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত হয়। এর লক্ষ্য হল ভারত ও পাকিস্তানের ধর্মীয় তীর্থযাত্রীদের অপর দেশে অবস্থিত উপাসনালয়গুলোতে ভ্রমণের সুবিধা প্রদান করা। ২০১৮ সাল পর্যন্ত, চুক্তিতে পাকিস্তানের ১৫টি এবং ভারতের পাঁচটি স্থানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

প্রোটোকলের অধীনে, প্রতিবছর যেকোনো ধর্মীয় উৎসবে তিন হাজার পর্যন্ত শিখ তীর্থযাত্রী পাকিস্তানে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছেন। তবে ২০২৫ এর শুরুতে, আজমির শরীফে হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর বার্ষিক ওরসের জন্য মাত্র ১০০ জন পাকিস্তানি তীর্থযাত্রীকে ভিসা দিয়েছে ভারত। যা বরাদ্দকৃত ৫০০ জনের কোটার চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে কম।

পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা নিষিদ্ধকরণ চুক্তি

১৯৮৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে এই চুক্তি হয়। প্রতি বছরের এক জানুয়ারি উভয় দেশকে তাদের পারমাণবিক স্থাপনা সম্পর্কে একে অপরকে অবহিত করার বিধান রয়েছে। চুক্তিতে আরও বলা হয়েছে যে, উভয় দেশকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অন্য দেশের যেকোনো পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস বা ক্ষতি করার লক্ষ্যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ, উৎসাহিত করা বা অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

আকাশসীমা লঙ্ঘন প্রতিরোধ সংক্রান্ত চুক্তি

১৯৯১ সালের ৬ এপ্রিল নয়াদিল্লিতে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে এই চুক্তি হয়। এর লক্ষ্য ছিল প্রতিবেশি দেশগুলির মধ্যে দুর্ঘটনাজনিত বা অনিচ্ছাকৃত আকাশসীমা লঙ্ঘনের ঝুঁকি হ্রাস করা। এবং একে অপরের আকাশসীমার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে সামরিক বিমান না উড়ার নিয়ম প্রতিষ্ঠা করা। এতে আরও বলা হয়েছে যে, পূর্ব অনুমতি ছাড়া উভয় দেশের কোনো বিমানকে আঞ্চলিক জলসীমার উপর দিয়ে অন্যদেশের আকাশসীমায় প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। মাঝেমাঝে লঙ্ঘন সত্ত্বেও এই চুক্তিটি মূলত উভয় দেশই মেনে চলেছে। পহেলগাম হামলার পর ভারতের আক্রমণাত্মক পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায়, পাকিস্তান ভারতীয় সমস্ত বিমান তাৎক্ষণিকভাবে তার আকাশসীমা ব্যবহার বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছে।

লাহোর ঘোষণাপত্র

১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহরি বাজপেয়ীর পাকিস্তান সফরের সময় এই ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন বাজপেয়ি এবং নওয়াজ শরীফ। এর লক্ষ্য ছিল আলোচনার মাধ্যমে অমীমাংসিত সমস্যাগুলো, বিশেষ করে কাশ্মীর সম্পর্কিত সমস্যাগুলো সমাধান করা। তবে ১৯৯৯ সালের মে মাসে কার্গিল যুদ্ধের কারণে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে এই চুক্তির ভবিষ্যত।

নিয়ন্ত্রণ রেখায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি

২০০৩ সালের নভেম্বরে, পাকিস্তান-ভারত নিয়ন্ত্রণ রেখা এবং কার্যকরী সীমানা বরাবর যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। নিয়ন্ত্রণ রেখা হলো সীমান্তরেখা, যা বিতর্কিত কাশ্মীর উপত্যকাকে দুই দেশের মধ্যে বিভক্ত করে। চুক্তিটি কয়েক বছর ধরে বহাল ছিল। কিন্তু ২০০৮ সাল থেকে নিয়মিত লঙ্ঘনের খবর পাওয়া গেছে। ২০১৪ সালে ভারতের নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর এই লঙ্ঘনের মাত্রা বেড়ে যায়।

এসএস