নেপাল ও ভারতের সিকিম রাজ্যের সীমান্তে অবস্থিত কাঞ্চনজঙ্ঘার উচ্চতা প্রায় ৮ হাজার ৫৮৬ মিটার (২৮১৬৯ ফুট)। এভারেস্ট ও কে-২ এর পর এটি বিশ্বের উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গগুলোর একটি। হিমালয়ের এ অংশকে বলা হয় ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা হিমালয়’। সিকিম রাজ্যে অবস্থিত কাঞ্চনজঙ্ঘা জাতীয় উদ্যান ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃত।
প্রতিবেশী দেশে শৃঙ্গটির অবস্থান হলেও বছরের অক্টোবর থেকে নভেম্বরে পঞ্চগড়ের বিভিন্ন জায়গা থেকে এটি স্পষ্ট দেখা যায়।তবে সবচেয়ে ভালো দেখা যায় তেঁতুলিয়া থেকে।

বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর থেকে এ শৃঙ্গের দূরত্ব খুব বেশি নয়। এখান থেকে নেপাল মাত্র ৬১ কিলোমিটার, ভুটান ৬৪ কিলোমিটার, চীন ২০০ কিলোমিটার, ভারতের দার্জিলিং ৫৮ কিলোমিটার আর শিলিগুড়ি মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে। হিমালয়ের এভারেস্ট শৃঙ্গ যেখানে ৭৫ কিলোমিটার দূরত্বে, সেখানে কাঞ্চনজঙ্ঘা রয়েছে মাত্র ১১ কিলোমিটার দূরে। মেঘ বা কুয়াশামুক্ত নির্মল আকাশে উত্তর-পশ্চিম দিকে তাকালেই ভেসে ওঠে বরফে মোড়া সাদা পাহাড়—কাঞ্চনজঙ্ঘা।
গত ২ সেপ্টেম্বর পঞ্চগড়ের জালাসি এলাকা থেকে স্পষ্ট দেখা যায় বরফে মোড়া কাঞ্চনজঙ্ঘা। সাধারণত হেমন্ত ও শীতকালে মেঘমুক্ত আকাশে ভোরবেলা এর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য ধরা দেয়। শীত মৌসুমে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য পর্যটক ভিড় করেন তেঁতুলিয়ায়, শুধু কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করতে।
পাঁচ গড়ের পঞ্চগড়—
বাংলাদেশের সর্বউত্তরের জেলা পঞ্চগড়। ১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রংপুর থেকে আলাদা হয়ে এটি স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ভৌগোলিকভাবে এর পূর্বে ফাঁমাগড় প্রশাসন, পশ্চিম ও উত্তরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং দক্ষিণে ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর জেলা অবস্থিত।
আরও পড়ুন:
জেলার নামকরণ নিয়ে রয়েছে দুটি প্রচলিত কিংবদন্তি। এক মতে, প্রাচীন পুণ্ড্রনগর রাজ্যের অধীনে থাকা পঞ্চনগরী নামক একটি অঞ্চল থেকেই পঞ্চগড় নামটি এসেছে। অপর মতে, এ অঞ্চলে ছিল পাঁচটি ঐতিহাসিক দুর্গ— ভিতরগড়, হোসাইনগড়, মীরগড়, দেবেনগড় ও রাজনগড়। এই পাঁচ দুর্গ থেকেই পরবর্তীতে জায়গাটির নাম হয় পঞ্চগড়, যার অর্থ দাঁড়ায় পাঁচ গড়।
কোথায় দেখা যাবে কাঞ্চনজঙ্ঘা—
বাংলাদেশ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে সবচেয়ে ভালো জায়গা তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো। মহানন্দা নদীর পাড়ে অবস্থিত এই জায়গা থেকে অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে বেশির ভাগ সময়ই দেখা মেলে বরফে মোড়া শৃঙ্গটির।
এ ছাড়া পঞ্চগড় শহরের করতোয়া সেতুতে দাঁড়িয়ে কিংবা শহরের কোনো উঁচু ভবন থেকেও মেঘমুক্ত আকাশে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা। এমনকি পঞ্চগড় থেকে তেঁতুলিয়া যাওয়ার পথে যাত্রীরা রাস্তার বিভিন্ন মোড়ে কখনো সামনে, কখনো ডানে, আবার কখনো বাঁয়ে হঠাৎই চোখে পড়ে এই অপরূপ দৃশ্য।
কীভাবে যাবেন পঞ্চগড়—
ঢাকা থেকে পঞ্চগড় যেতে চাইলে দুটি মাধ্যম রয়েছে—বাস ও ট্রেন। রাজধানীর গাবতলী, শ্যামলী ও মিরপুর থেকে প্রতিদিন সরাসরি পঞ্চগড়ের বাস ছাড়ে। নন-এসি বাসে ভাড়া জনপ্রতি ৯০০ থেকে ১১০০ টাকা এবং এসি বাসে ১৩০০ থেকে ১৯০০ টাকার মধ্যে পড়ে। পঞ্চগড় শহরে পৌঁছে লোকাল বাসে সহজেই তেঁতুলিয়া যাওয়া যায়, যেখানে জনপ্রতি ভাড়া ৫০ থেকে ৬০ টাকা। এই পথে যাতায়াতের সময় এশিয়ান হাইওয়ে ধরে যাওয়া হয়, আর ভাগ্য ভালো হলে দূরের আকাশে দেখা মেলে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্যের। চাইলে ঢাকা থেকে সরাসরি তেঁতুলিয়াগামী বাসেও যাওয়া যায়, যার ভাড়া প্রায় ১১৫০ টাকা।
ট্রেনে ভ্রমণ করতে চাইলে ঢাকার কমলাপুর থেকে সরাসরি পঞ্চগড়গামী ট্রেন পাওয়া যায়। শ্রেণিভেদে ভাড়া জনপ্রতি সর্বনিম্ন ৭৪০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২৫৯৮ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। আর পঞ্চগড় শহরে নেমে ঘোরাঘুরির জন্য সহজেই পাওয়া যায় প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাস। এগুলো রিজার্ভ করতে ভাড়া পড়তে পারে আনুমানিক ২০০০ থেকে ৩০০০ টাকা।

এসে থাকবেন যেখানে—
পঞ্চগড় ভ্রমণে গেলে থাকার জন্য রয়েছে নানান সুযোগ-সুবিধা। জেলা শহরে সরকারি সার্কিট হাউসের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং সড়ক ও জনপদ বিভাগের গেস্টহাউস রয়েছে। বেসরকারি আবাসনের মধ্যে হোটেল মৌচাক, হোটেল প্রিতম, সেন্ট্রাল গেস্টহাউস, অগ্রদূত প্যালেস, এইচ কে প্যালেস ও ধানসিঁড়ি উল্লেখযোগ্য।
অন্যদিকে তেঁতুলিয়ায় রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের থাকার ব্যবস্থা। মহানন্দা নদীর তীরে উঁচু টিলার ওপর শতবর্ষ পুরোনো ব্রিটিশ আমলের ঐতিহাসিক তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো এখন জেলা পরিষদ ডাকবাংলো হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যেখানে আগেভাগে যোগাযোগ করলে থাকার সুযোগ মেলে। এছাড়া পুলিশের অফিসার্স মেস, উপজেলা পরিষদের বেরং কমপ্লেক্স, সড়ক ও জনপদ, বন বিভাগ, শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের গেস্টহাউসেও থাকা যায়।
আরও পড়ুন:
বেসরকারিভাবে তেঁতুলিয়ায় হোটেল দোয়েল, স্কয়ার হোটেল, স্বপ্ন গেস্টহাউস, কাঠের বাড়ি গেস্টহাউস, হোটেল সীমান্তের পাড়, হোটেল কাঞ্চনজঙ্ঘা, কাজী ব্রাদার্সসহ বিভিন্ন হোটেল রয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইএসডিও পরিচালিত মহানন্দা কটেজও পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় আবাসন কেন্দ্র।
হোটেল ভাড়া ও খাবার—
তেঁতুলিয়া উপজেলায় আবাসনের জন্য বিভিন্ন দামের হোটেল পাওয়া যায়। এখানে নন-এসি রুম ভাড়া জনপ্রতি ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা এবং এসি ডাবল বেডের ভাড়া ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে হয়ে থাকে। এছাড়া ডাকবাংলোর কক্ষ ভাড়া ৪০০ টাকা।
পঞ্চগড় ভ্রমণে স্থানীয় খাবারের স্বাদ নিতে চাইলে মিলবে কিছু ঐতিহ্যবাহী খাবার। খাবারগুলোর মধ্যে ডিম ভুনা, শীদলের ভর্তা, পাটা শাকের খাটা, কাউনের ভাত, সজির মুড়ার ছ্যাকা ও মোড়ত লাভা শাকের পেলকা উল্লেখযোগ্য।

পঞ্চগড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়া আরও যা দেখবেন
কাঞ্চনজঙ্ঘার মোহনীয় দৃশ্যের পাশাপাশি পঞ্চগড় জেলায় ছড়িয়ে আছে ইতিহাস ও প্রকৃতির অসংখ্য সৌন্দর্য। এখানে রয়েছে মহারাজার দিঘী, যেখানে প্রকৃতিপ্রেমী ভ্রমণকারীরা খুঁজে পান নির্জনতার প্রশান্তি। জেলার বিভিন্ন চা বাগানও পর্যটকদের কাছে সমান আকর্ষণীয়।
ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য রয়েছে ভিতরগড়, শাহী মসজিদ ও মিরগড়ের মতো নিদর্শন। সীমান্তঘেঁষা জিরো পয়েন্টও ঘুরে দেখার মতো একটি জায়গা।
এছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য জ্ঞানভাণ্ডার রক্স মিউজিয়াম এবং আধ্যাত্মিক পরিবেশের খোঁজে আসা মানুষের কাছে বারো আউলিয়া মাজার বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। ফলে পঞ্চগড় শুধু কাঞ্চনজঙ্ঘার নয়, বরং ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক নিদর্শনেরও এক অনন্য ভাণ্ডার।