সমঝোতার রাজনীতির ভিত গড়ছে ঐকমত্য কমিশন!

ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলের নেতারা
দেশে এখন
বিশেষ প্রতিবেদন
0

গেল ছয় মাস ধরে রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্দেশে ঐকমত্য কমিশনে রাজনীতিকদের মধ্যে তৈরি হয়েছে অনেক সুখ-স্মৃতি, সৌহার্দ্য-আন্তরিকতার অনেক উপকরণ। এখানে ছোটখাটো কিছু বাদানুবাদের পরও অংশগ্রহণকারীরা বলছেন, সবাই ‘এক ছাতার’ নিচে সমবেত হয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে সামনে এগিয়ে নেয়ার যে উদাহরণ তৈরি হয়েছে, তা কেবলই সোনালি দিনেরই জানান দেয়। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর দলাদলি-সংঘাতের বদলে এখানে সহমর্মিতা, পরমতসহিষ্ণুতার যে চর্চা শুরু হলো তা আগামী দিনের রাজনীতিকে দিশা দেখাবে।

দুর্যোগ এলে ভুক্তভোগী সবাই! দেশের প্রায় সবকটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের হুড়োহুড়ি, কারণ হঠাৎ ফায়ার এলার্ম বেজে উঠেছে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে।

বিপদের প্রশ্নে যে এক থাকতে হবে, ঐকমত্য কমিশনে রাজনীতিকদের মধ্যে সৌহার্দ্যের এমন স্মৃতি তৈরি হয়েছে প্রতিমুহূর্ত, যদিও রাজনীতির মাঠে বক্তব্য বিবৃতিতে তাদের কত দূরত্ব, আদর্শে কত ভিন্নতা!

উদাহরণ দিয়ে বলতে গেলে, বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ আর জামায়াত নেতা আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের, এমনভাবে হেসে কথা বলেন যে দেখে বোঝার উপায় নেই প্রায়সময়ই তারা রাজনীতিতে একে অন্য দলকে সমালোচনা করে বক্তব্যও রাখছেন। সত্য কথা বলতে, রাজনৈতিক বিরোধিতা। কিন্তু তারপর পাশাপাশি বসে দুই দণ্ড কথা বলার ফুরসত, এমন সৌহার্দ্যই তো দেখতে চেয়েছে এদেশের মানুষ।

তবে শুধু যে সম্পর্কের এই ধরণ বদলেছে তা-ই নয়, এমন কিছু দৃশ্যও দেখা যাচ্ছে যেটা কিছুদিন আগেও মনে হতো অকল্পনীয়। যেমন বামপন্থী দলগুলোর, ইসলামপন্থী দলের সঙ্গে একসঙ্গে বসা। তাদের মধ্যে হয়তো মৈত্রী বা জোট গড়ে উঠছে না কিন্তু একসাথে এক বৈঠকে বসা তো হলো। নতুন বাংলাদেশে সব দল, সব ধর্ম আর মত একসঙ্গে বাঁচবে এটাও তো বড় পাওয়া।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘আপনি চাইলেই কি বিভিন্ন মতাদর্শের রাজনৈতিকদের বাংলাদেশ থেকে বের করে দিতে পারবেন? আপনি কি সমুদ্রে তাদের নিক্ষেপ করবেন? তাহলে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের মধ্যে নানা চিন্তা মতাদর্শের মানুষ থাকবে, ভিন্নমত থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক। বরং এতদিন যেটা অনুশীলন হয়েছে, সেটা একেবারেই একটা চর দখলের সংস্কৃতি ছিল। ভিন্নমত বা দ্বিমত করা মানে, আপনি হয়তো আমার রাজনৈতিক প্রতিযোগী হবেন কিন্তু নিশ্চয়ই আপনি আমার শত্রু না। সুতরাং এখন যেটা চর্চা করছি, এটাকেই ফিরিয়ে আনা দরকার।’

আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, ‘স্বাধীনতার পর এখনই একমাত্র প্রান্তিক দলগুলোও- ডান, বাম, ইসলামিস্ট, স্যাকুলার সব শ্রেণির মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর সঙ্গে এখানে একত্রে বসার একটা সুযোগ হয়েছে। আমি মনে করি, এটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য বড় পাওয়া।’

সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এটা অবশ্যই একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে যেহেতু স্বাধীনতার যে মূলমন্ত্র, সেটা জাতি অর্জন করতে পারেনি, পরিপূরণ করতে পারেনি। যে প্রস্তাবগুলো ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত হচ্ছে সেটা বাস্তবায়ন হলে, অবশ্যই আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত, আমাদের শহিদের রক্তের আকাঙ্ক্ষা এবং প্রত্যাশা অনুযায়ী রাষ্ট্র, সমাজ কাঠামো এবং সরকারব্যবস্থা বিনির্মাণ করতে পারবো।’

তাই বলে যে ঐকমত্য কমিশনের পুরো সময়টাই বন্ধুত্বের গল্প তেমনটাও নয়। তীব্র বাদানুবাদ হয়েছে, সভা ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন কোনো কোনো দল, কখনও কখনও মনোমালিন্য কিংবা হতাশাও দেখিয়েছেন কেউ কেউ।

কিন্তু এত দিনের এই বৈঠক, দিনব্যাপী যুক্তিতর্ক, হাসি-ঠাট্টা, খুনসুটি- সবমিলিয়ে দলগুলোর মধ্যে কি একটু পারিবারিক আবহ তৈরি হয়নি? আর অবশেষে যখন এই মিলনমেলা শেষ হচ্ছে, তখন কী অবচেতনে হলেও মনের মধ্যে কোনো বেদনা টের পাচ্ছেন কেউ কেউ।

এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, ‘চিফ জাস্টিস কে হবে? আমরা সব দল মিলে চা খেতে খেতে ঠিক করতে পানি কি না? প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে হবে? দুদকের চেয়ারম্যান কে হবে? এটা আমরা ঠিক করতে পারি কি না? এই ন্যাশনাল ইন্টারেস্টের জায়গায় যদি জাতি একমত হতে পারে তাহলে জাতি অনেক স্ট্রং হবে। আমাদের দেখে বাইরে যারা জনগণ প্রতিদিন আমাদের দেখছে তারা জাতির লিডারশিপের ওপর অনেক বেশি কনফিডেন্স পাবে।’

জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘কারও দলীয় যে পজিশন তার বাইরেও একটা পজিশন নেয়া ঐকমত্যের স্বার্থে। সেগুলোকেও অপারেট করার মতো একটা আন্তরিক পরিবেশ আমরা এখানে দেখেছি। সবথেকে বড় কথা হলো বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি যেখানে হানাহানি, বিদ্বেষ, মারামারি এবং প্রতিহিংসা পরায়ণতার যে রাজনীতি, তার বাইরে এসে ছোট হোক, বড় হোক, নতুন দল হোক বা পুরোনো দল হোক। সব দল যে আমরা একসঙ্গে কথা বলতে পারছি এটা আমাদের ইতিহাসে একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে।’

এ কয়দিনে সবুজে ঘেরা শান্ত ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ব্যস্ততা ছিল প্রতিটি ফ্লোরে, ক্যান্টিন, লাউঞ্জ কিংবা প্রতিটি হলরুমে। নিয়ম করে আগত অতিথিদের জন্য স্ন্যাক্স, দুপুরের খাবার এসব নিয়েও ব্যস্ততা ছিল তাদের নিয়ম করে। নামাজের জায়নামাজ কিংবা খাবারের টেবিলেও রাজনীতিকদের আরও কাছে এসে জানাশোনার সুযোগ তৈরি হয়েছে, জমেছে অনেক স্মৃতি।

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার বলেন, ‘যখন এই অভ্যুত্থান সফল হলো তখন এরকম একটা দৃশ্য আমার স্বপ্ন ছিল যে, একটা বড় রকমের সংস্কারের আলোচনা হবে এবং সেখানে গোটাজাতির আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে। ঠিক সে স্কেলে না হলেও এটা অনেক ব্যাপক একটা আয়োজন। ব্যাপক একটা আলোচনার ফোরাম। সেই ফোরামের মধ্য দিয়ে একটা নতুন গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার পথে এরইমধ্যে অনেক কিছু অর্জনের ব্যাপারে আমরা একমত হয়েছি।’

সময় টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিবেদক সানবীর রূপল বলেন, ‘নিজের কাছে একটু অন্যরকম লাগছে যে আবার হয়তো মারামারি, কাটাকাটির দিকে, দলাদলির দিকে তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে রাজনীতির মাঠে দেখবো। কিন্তু একসঙ্গে চা খেতে দেখার যে একটি আন্তরিকতা, সেটি যেমন দেশ যেমন মিস করবে, আমরা যারা সাংবাদিকরা এখানে কাভার করছি তারাও দীর্ঘদিন এই বিষয়টি মিস করবো।’

দৈনিক সমকালের রাজনৈতিক প্রতিবেদক রাজীব আহাম্মদ বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের একবছরে যত কাজ হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ। বাইরে অনেকরকম প্রশ্ন রয়েছে যে, কী সংস্কার হচ্ছে? রাস্তাঘাট তো সব আগের মতো, অফিস-আদালত সবকিছু আগের মতোই। আসলে এটি ঐকমত্য কমিশন বা সরকার, বা রাজনৈতিক দলগুলো বা সংবাদ মাধ্যম, সবাই যে জিনিসটি সাধারণ মানুষকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে, এখানে কতটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে। এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য খুবই ভালো যে একজন আরেকজনের কাথা শুনছে। সংস্কার যতটুকুই হোক এগুলো কিন্তু নোটে থাকছে। পাঁচ, দশ বছর পর গিয়ে যদি এগুলো না করেন তাহলে প্রশ্ন আসবে যে আপনি এগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কিন্তু এগুলো বাস্তবায়ন করছেন না। আপনি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করছেন।’

দু’এক দিনের মধ্যেই হয়তো পর্দা টানা হবে রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আয়োজিত অন্তর্বর্তী সরকারের এই মহা মিলনমেলা। আগামীর বাংলাদেশ নীতিতে, স্বচ্ছতায়, নিরপেক্ষতায় যতবার অর্জনের সিঁড়ি অতিক্রম করবে, ততবার হয়তো স্মরণ করা হবে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী মিনি সংসদখ্যাত এই ফরেন সার্ভিস একাডেমিকে।

এসএস