অ্যান্ডারসন-টেন্ডুলকার সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে ভারতের প্রথম ইনিংসে ৫৮৭ রানের বিশাল স্কোর। জবাবে ব্যাট করতে নেমে ইংল্যান্ড যেন প্রথম আধা ঘণ্টাতেই হেরে বসে আছে। স্কোরবোর্ডে রান তখন ৮৪, অথচ পাঁচ ব্যাটার প্যাভিলিয়নের পথ ধরে ফেলেছেন। ফলো অন তখন শুধু সম্ভাবনা নয়, প্রায় সময়ের অপেক্ষমান ঘটনা। গ্যালারিতে চলছে ভারতীয় সমর্থকদের উল্লাস, মাঠে ভারতীয় ফিল্ডারদের চোখে ছিল তৃতীয় দিনেই ম্যাচ শেষ করে দেয়ার রুক্ষ প্রত্যাশা। ঠিক সেই মুহূর্তে ব্যাট হাতে তুলে নিলেন হ্যারি ব্রুক ও জেমি স্মিথ।
একদিকে হ্যারি ব্রুক, যার ব্যাটিংয়ে আছে কল্পনার বিস্তার, সময়ের ছন্দে তর্জন। অনেকেই তাকে বলে থাকেন ‘বাটলারের ছোট সংস্করণ।’ বাটলারের মতোই একইরকম আত্মবিশ্বাসী, একইরকম প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলার ব্যাকরণ জানা। তার ইনিংসের পেছনে আছে আরও একটি ব্যক্তিগত আবেগ। নানার সঙ্গে তার সম্পর্ক, যার মৃত্যু পরবর্তী শত রানে তিনি বলেছিলেন, ‘এই ইনিংসটা নানুর জন্য।’ এই ম্যাচেও যেন নানার ভালোবাসাই তাকে শক্তি জুগিয়েছে। খেললেন ১৫৮ রানের এক অনবদ্য ইনিংস।
অন্যদিকে জেমি স্মিথ শান্ত, স্থির। তবে ব্যাটে যেন প্রজ্বলিত আগুন। যার উইলো থেকে বয়ে আসে সাহসী ব্যাকফুট ড্রাইভ, স্কয়ার কাট, আর অসাধারণ প্রজ্ঞার পরিণত প্রয়োগ। তাকে ডাকা হয় ‘দ্যা কুয়াইট আসাসিন’। যিনি অনুশীলনের ফাঁকে পড়েন দর্শনের বই, আর মাঠে পরিণত হন প্রতিপক্ষের মস্তিষ্ক ভেঙে দেয়ার কৌশলী গুটি হিসেবে।
স্মিথ ইনিংসটি শেষ করেন ১৮৪ রানে। দুজন মিলে গড়েন ৩০৩ রানের এক মহাকাব্যিক জুটি। আর এই জুটির ভাঙনের মাত্র ২০ রান পরেই অলআউট হয়ে যায় ইংল্যান্ড। ভারত পায় ১৮০ রানের লিড।
এ শুধু রান নয়, এ এক দর্শনের বহিঃপ্রকাশ। এই ইনিংস বলছে না যে, বাজবল মানে শুধু চার-ছয়ের ঝড়। বরং এটি বলছে, বাজবল মানে ভয়হীন আত্মবিশ্বাস, প্রতিপক্ষকে নিজের ছন্দ থেকে সরিয়ে আনা, আর মাঠে নিজস্ব গতিতে খেলার সাহস। ব্রেন্ডন ম্যাককালাম ও বেন স্টোকসের গড়া এই দর্শনে বলা হয় ‘রান করো, ব্যর্থ হলেও ভয় নেই। শুধু চেষ্টা করো নিজের মতো করে খেলতে।’ ব্রুক ও স্মিথ সেই দর্শনের ধারক ও বাহক।
তারা জানেন কখন নতুন বলকে কাজে লাগিয়ে চার নিতে হয়, আর কখন সিঙ্গেল নিয়েও চাপ তৈরি করা যায়। তাদের ইনিংসে ছিল আগ্রাসনের ছোঁয়া, কিন্তু মাথাভর্তি ছিলো পরিকল্পনা। তাদের প্রতিরোধ ছিল সাহসের, আবার রণনীতিরও। এই ম্যাচে কেউ জিতলো, কেউ হারলো তা নয়। জিতলো টেস্ট ক্রিকেটের প্রাণ। সেই ধৈর্যের পরীক্ষা, সেই বিশ্বাসের বলি হয়ে না গিয়ে লড়াই করে যাওয়ার মন্ত্র।
হ্যারি ব্রুক ও জেমি স্মিথ দেখিয়ে দিলেন ধংসস্তুপ থেকে কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়। প্রবল ঝড়ের মাঝেও কীভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে হয়। কীভাবে উদযাপন থামিয়ে দেয়া যায় নিঃশব্দ প্রতিরোধে। এই ইনিংস কেবল ৩০৩ রানের জুটি নয়, বরং এক দর্শনের ঘোষণা। বাজবল এখন শুধু টার্ম নয়, এক বিশ্বাস। যেখানে সাহসই চালিকাশক্তি, আর ব্যর্থতার ভয় হারিয়ে গিয়ে জায়গা করে নেয় স্বাধীনতা। তাদের ইনিংস দুটি এক ধ্রুপদী কাব্য। আর ব্রুক-স্মিথ সেই কাব্যের প্রধান দুই চরিত্র।