ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তে এ সড়ক এঁকে দিচ্ছে বাংলাদেশের নতুন মানচিত্র। সেনাবাহিনী বলছে, অরক্ষিত এ সীমান্ত অঞ্চল পাহাড়ি সশস্ত্র গোষ্ঠী, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের অভয়ারণ্য। তবে এ সড়ক তৈরি করেছে ভূকৌশলগত নিরাপত্তা বলয়। যেখান থেকে সীমান্তে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর নজরদারি বাড়াচ্ছে সংস্থাগুলো। উঁচু, নিচু পাহাড় কেটে এ সড়ক নির্মাণ ছিল বড় চ্যালেঞ্জ, যেখানে হতাহত হয়েছেন সেনা সদস্যসহ ২৬ জন।
দুই থেকে তিন হাজার ফুট উচ্চতায়, মেঘ ছুঁয়ে যাওয়া পাহাড়ি আঁকাবাঁকা সড়ক। প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার এ পথের চারপাশে অবারিত সবুজ, বন বনানী আর জুম চাষের দৃশ্য চোখে পড়ে।
২০২০ সালে শুরু হয় দেশের প্রথম এ সীমান্ত সড়ক প্রকল্প। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩১৭ কিলোমিটারের নির্মাণ কাজ শেষ করেছে সেনাবাহিনী।
৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মো. শামসুক আলম বলেন, ‘পাহাড়ের জনপদের অনেক জায়গায় যোগাযোগের কিছু নেই। ম্যাটারিয়ালস কোথা থেকে নিবে তার কোনো ঠিক নেই, অনেকদূর থেকে ম্যাটারিয়ালসগুলো বয়ে নিয়ে আসতে হয়। এত ভারী জিনিসগুলো এত উপরে বয়ে নিয়ে আসা, সেখানে কাজ করানো আবার সেখান থেকে নিরাপদে ফেরত নিয়ে আসা, অনেক ঝুঁকি নিয়ে এখানে কাজ করতে হয়েছে। ইন্ডিয়ার পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা এবং মায়ানমারের কিছু অংশ নিয়ে যে অঞ্চলটা আমার এতদিন ম্যাপে দেখতাম আমাদের দেশের সীমানাগুলো। সেগুলো আমরা এখন রোড কনস্ট্রাকশনের মাধ্যমে মুভ করছি।’
এ সড়ক নির্মাণে প্রথমে হেলিকপ্টার, তারপর ড্রোন সার্ভে সবশেষে মাস কিংবা সপ্তাহ একটানা পায়ে হেটে এ সড়কের নকশা প্রস্তুত করতে হয়েছে। পরামর্শ নিতে হয়েছে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের বিশেষজ্ঞদের থেকেও। দেশে এটিই একমাত্র পথ যেটি নির্মাণে প্রাণ দিয়েছেন সেনা সদস্যসহ ৭ জন। হতাহত হয়েছেন মোট ২৬ জন।
সীমান্ত সড়ক প্রকল্পের পিডি কর্নেল দেলোয়ার হোসেন তালুকদার বলেন, ‘খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি এবং বান্দরবান এই তিনটি জেলার ওপর দিয়ে যাচ্ছে এই রাস্তা। এবং এই তিন জেলার মাটির বৈশিষ্ট্য তিন রকম। কোনো কোনো জায়গায় পাথুরে পাহাড় আছে, কোনো জায়গায় কর্দমাক্ত আবার কোনো জায়গায় মাটির বড় ধরনের ফাটল আছে। এগুলোর জন্য অনেকসময় রাস্তার কাজ দেরি হয়, এবং অনেকসময় দেখা যায় বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে আমরা অনেক ধরনের প্রতিবন্ধকতায় পড়ি।’
ভারত ও মিয়ানমারের এ সীমান্তে কোন তারকাঁটা নেই, ফলে মাদক অস্ত্র চোরাচালান ও সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতার রুট ছিল এসব এলাকা। অবাধে যাতায়াত ছিল দুই পারে। তাই এ সড়ক জাতীয় নিরাপত্তা ও অপরাধ নির্মূলের কৌশলগত হাতিয়ার।
১৭ ইসিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল নূর মোহাম্মদ সেলিম বলেন, ‘আগে যেখানে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা ঝিরি ধরে সরু পথ বানিয়ে গহীন জঙ্গলে চলে যেতো, এখন সেটা করতে পারছে না। কারণ এখন সেখানে রাস্তা হয়ে গেছে।’
সেনাবাহিনী বলছে, সীমান্ত সুরক্ষিত করতে এ অঞ্চলে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর নজরদারি বাড়বে। ড্রোন সার্ভিল্যান্স, সিসিটিভি ও রেডিও কমিউনিকেশনের মাধ্যমে পরিধি বাড়াবে বিভিন্ন বাহিনী। বাড়বে প্রশাসনিক কার্যক্রমও ।
২০ ইসিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল আসিফ আহমেদ তানজিল বলেন, ‘যখন কুইক রেসপন্স টাইমটা কমে যাবে তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। নিরাপত্তার বিষয়ে এটার একটা বিশাল অগ্রগতি হয়েছে।’
তিনভাগে এ সীমান্ত সড়কের ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটারের কাজ শেষ করতে সময় লাগবে আরো ১০ বছর। বর্তমানে দ্বিতীয় পর্যায়ে ২৮৮ কিলোমিটার সড়কের কাজ শুরু করেছে সেনাবাহিনী।