ফোর্দো পারমাণবিক কেন্দ্র ধ্বংসে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে মার্কিন যুদ্ধবিমান

ইরানের ফোর্দো পারমাণবিক কেন্দ্র
মধ্যপ্রাচ্য
বিদেশে এখন
0

দুর্গম পাহাড়ে নির্মিত পারমাণবিক কেন্দ্র, যার সুরক্ষা ব্যবস্থা ভূগর্ভস্থ বাঙ্কার বিধ্বংসী বোমার চেয়েও শক্তিশালী। বিশ্বজুড়ে আলোচনায় ইরানের ফোর্দো পারমাণবিক স্থাপনা, যেটি ধ্বংসের সক্ষমতা কেবল মার্কিন অস্ত্রভাণ্ডারে থাকা জিবিইউ ফিফটি সেভেন বোমা আর বি-টু স্টিলথ বোমারু বিমানেরই রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র কি পারবে ফোর্ডোতে হামলা চালাতে? বলা হচ্ছে, প্রস্তুতি হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে মার্কিন যুদ্ধবিমান।

উঁচু উঁচু সব পাহাড় ভেদ করে ঢুকে গেছে পাঁচ পাঁচটি সুড়ঙ্গ। পাশেই বিশাল এক সাপোর্ট বিল্ডিং বা সহায়ক স্থাপনা। সবকিছুই অবস্থিত আরও বড় এক উচ্চ সুরক্ষিত এলাকার ভেতর। সাম্প্রতিক স্যাটেলাইট ছবিতে বাইরে থেকে এটুকুই দেখা যায় ইরানের রহস্যে ঘেরা ফোর্ডো জ্বালানি সমৃদ্ধকরণ প্রকল্পের।

ভীষণ গোপনীয়তা আর সার্বক্ষণিক কড়া পাহারায় থাকা এই স্থাপনার অবস্থান, শিয়া অধ্যুষিত ইরানে পবিত্রভূমি খ্যাত কোম শহরের কাছে। ২০০৯ সালে প্রথম প্রকাশ্যে আসলেও এটির নির্মাণকাজ চলছিল আরও অন্তত সাত বছর আগে। শুরু থেকেই গুঞ্জন রয়েছে স্থাপনাটির প্রকৃত উদ্দেশ্য আর আকৃতি নিয়ে। যতটুকু জানা যায়, তাও ইসরাইলি গুপ্তচরদের চুরি করা ইরানের গোপন নথিতে থাকা অল্প কিছু তথ্য। বলা হয়, ফোর্ডোর প্রধান হল বা বড় কক্ষগুলো ভূপৃষ্ঠের ২৬২ থেকে ২৯২ ফুট গভীরে অবস্থিত; যা ইসরাইলি বিমান বাহিনীর ভাণ্ডারে থাকা যেকোনো বোমার আয়ত্তের বাইরে। অর্থাৎ আকাশপথে হামলা চালিয়ে এই স্থাপনা ধ্বংস করা প্রায় অসম্ভব।

ইরান-ইসরাইল সংঘাত তীব্র হতে থাকার মধ্যেই কিছু বিশ্লেষকের ধারণা, চলমান ইসরাইলি বিমান হামলার মূল লক্ষ্য আসলে ফোর্ডো। বলা হচ্ছে, ইসরাইলি গুপ্তহত্যায় বিপর্যস্ত ইরানি শাসকগোষ্ঠী সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুতকে দ্রুত পারমাণবিক বোমায় রূপ দিতে চাইলে, ফোর্ডোই সে স্থান যেখানে এ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। সম্প্রতি একাধিকবার ফোর্ডো লক্ষ্য করে ইসরাইল হামলা চালিয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা আইএইএ। কিন্তু এখন পর্যন্ত স্থাপনাটিতে আঁচড় কাটতে পারেনি যুদ্ধবাজ দেশটি।

আইএইএর মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রসি বলেন, ‘ফোর্ডো জ্বালানি সমৃদ্ধকরণ প্রকল্পে কোনো ক্ষয়ক্ষতি দেখা যায়নি। নাতাঞ্জ জ্বালানি সমৃদ্ধকরণ প্রকল্পেও নতুন কোনো ক্ষতি হয়নি। শুক্রবারের হামলায় শুধু ভূ-পৃষ্ঠের ওপরে প্রকল্পটির আংশিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’

ইরান নিজেদের পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ এবং জ্বালানিকেন্দ্রিক বলে দাবি করলেও, ফোর্ডো জ্বালানি সমৃদ্ধকরণ প্রকল্প দেশটির পারমাণবিক বোমা তৈরির কেন্দ্রে বলে ধারণা যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও পশ্চিমা দেশগুলোর। আইএইএকে ইরানের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এই এক স্থাপনাই তিন হাজার ইউরেনিয়াম সেন্ট্রিফিউজ ধারণে সক্ষম। ২০১৫ সালে ঐতিহাসিক পরমাণু চুক্তির আওতায় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিলের বিনিময়ে ফোর্ডো থেকে দুই-তৃতীয়াংশ সেন্ট্রিফিউজ সরিয়ে ফেলতে ইরানকে বাধ্য করার মাধ্যমে পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের ঝুঁকিতে লাগাম টানে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যান্য পরাশক্তি। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় এসে ২০১৮ সালে চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিলে চুক্তির শর্ত থেকে বেরিয়ে যেতে শুরু করে ইরানও। বর্তমানে ফোর্ডোতে ২৭শ' সেন্ট্রিফিউজ রয়েছে।

আইএইএর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের তথ্য, ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণে সক্ষম ফোর্ডো। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিংক ট্যাংক ইনস্টিটিউট ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি বা আইসিসের তথ্য, ইরানের ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের বর্তমান মজুতকে তিন সপ্তাহের মধ্যে ২৩৩ কেজির ওয়েপন-গ্রেড ইউরেনিয়াম বা নয়টি পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্রে রূপ দিতে সক্ষম ফোর্ডো। আর এ কারণেই ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংসের চেষ্টায় ইসরাইলের কেন্দ্রীয় লক্ষ্য ফোর্ডো। কিন্তু আদৌ কি এটি ধ্বংস করা সম্ভব?

বলা হয়, দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় মাটির কয়েকশ' ফুট নিচে নির্মিত ফোর্ডোর সুরক্ষা ব্যবস্থা ভূগর্ভস্থ বাঙ্কার বিধ্বংসী বোমার চেয়েও শক্তিশালী। এটি ধ্বংসের কেবল মার্কিন অস্ত্রভাণ্ডারে থাকা বি-টু স্টিলথ বোমারু বিমানই সাহায্য করতে পারে বলে ধারণা করা হয়। যদিও, যুক্তরাষ্ট্রের কথিত বাঙ্কার বিধ্বংসী ‘জিবিইউ ফিফটি সেভেন ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর বোমা ভূপৃষ্ঠের ২শ’ ফুটেরও কম গভীরে আঘাত হানতে সক্ষম। যেখানে ফোর্ডোর গভীরতা আরও বেশি। ফলে জিবিইউ ফিফটি সেভেনও আসলে ফোর্ডোর গভীরে পৌঁছাতে সক্ষম নয়। এ অবস্থায় কয়েকটি জিবিইউ ফিফটি সেভেনের একযোগে আঘাত ফোর্ডো ধ্বংসে সহায়ক হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। আর ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের এই একেকটি বোমা বহনে সক্ষম কেবল বি-টু স্টিলথ বোমারু বিমান। জিবিইউ ফিফটি সেভেন বোমা বা বি-টু স্টিলথ বোমারু বিমান- কোনোটাই নেই ইসরাইলের অস্ত্রভাণ্ডারে, নিতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকেই।

সেন্টার ফর নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির ডিফেন্স প্রোগ্রামের ফেলো কার্লটন হ্যালিগ বলেন, ‘লক্ষ্যে সফলভাবে আঘাত হানতে যেকোনো দেশের অস্ত্রভাণ্ডারে এটি একমাত্র অস্ত্র এবং সম্ভবত ফোর্ডোর মতো স্থাপনা ধ্বংসে সক্ষম। মূলত পাহাড়ি অঞ্চলে লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ ও আঘাত হানার লক্ষ্য নিয়ে এটির নকশা করা হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে উত্তর কোরিয়া, আর তারপর ইরানের কথাও মাথায় নিয়ে এ বোমা তৈরি হয়। কিন্তু তাও এমন একটি বা দু'টি বোমা দিয়েও ফোর্ডোকে ধ্বংস, বা এমনকি অচল করাও সম্ভব কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।’

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের মঙ্গলবারের বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন বলছে, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি জোরদারের মধ্যেই পূর্বের দিকে যেতে থাকা জ্বালানি বহনক্ষম মার্কিন বিমান বাহিনীর ৩১টির বেশি উড়োযান শনাক্ত করেছে ফ্লাইট ট্র্যাকিং ওয়েবসাইট এয়ারনেভ সিস্টেমস। ধারণা করা হচ্ছে, একবার জ্বালানি নিয়েই ছয় হাজার মাইলের বেশি পথ পাড়ি দিতে সক্ষম ভূগর্ভস্থ বাঙ্কার বিধ্বংসী বি-টু স্টিলথ বোমারু বিমানের সহায়ক হিসেবে পূর্ব দিকে যাচ্ছে রিফুয়েলিং এয়ারক্রাফটগুলো।

এসএস