আ.লীগের নিষিদ্ধের ঘটনায় কী ভাবছেন বিশ্লেষকরা?

রাজনীতি বিশ্লেষক এহসানুল এবং দিলারা
দেশে এখন
0

বিশ্লেষকরা বলছেন, গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের মাধ্যমে এটাই প্রমাণ হয়েছে; জনআকাঙ্ক্ষা ধারণে ব্যর্থ হলে যেকোনো দলের পরিণতি খারাপ হয়। আর আইনজীবীরা বলছেন, বিশ্বে বহু দল নিষিদ্ধের ঘটনা রয়েছে। আইন মেনে এটা করতে কোনো সমস্যা নেই।

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর চালানো এসব বর্বরতা সামনে এনেই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে মাঠে নামে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য নামের প্ল্যাটফর্ম।

এসব সহিংসতার সাক্ষী এখানকার মানুষ কিন্তু বিষয়টি এখনও বিচারাধীন রয়েছে দেশের বিভিন্ন আদালতে। 

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে এবং সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগ কী পরিমাণ দমন-পীড়ন চালিয়েছে, গেল দেড় দশকের শাসনামলে তা নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতসহ বিভিন্ন সংস্থায় বিচার ও তদন্ত চলছে। 

তবে জাতিসংঘের এই তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনটি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের পক্ষে একটা দলিল হিসেবে কাজ করেছে বলে মনে করেন কেউ কেউ। 

এর ৫ নম্বর পাতায় আছে, সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং অন্যান্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের সহিংস গোষ্ঠীও অংশ নিয়েছে। এতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পূর্ণ জ্ঞান, প্রত্যক্ষ নির্দেশনা ও সমন্বয় ছিলো।

কিন্তু এই প্রতিবেদনের সুপারিশেই রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ না করার কথাও বলে হয়েছিলো। রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরীর কাছে প্রশ্ন ছিলো, নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘জাতিসংঘ তাদের রিপোর্টে যা কিছু বলেছে, তার সবই যে একটা দেশ মানবে তা তো না। তারা বলবে দলকে নিষিদ্ধ করো না, তখন বলবে, আমরা তো নিষিদ্ধ করিনি, কার্যক্রম স্থগিত করেছি। সবচেয়ে ভালো হত যদি একটা এক্সেকিউটিভ অর্ডার দিয়ে তাদের কার্যক্রম ও পলিটিক্সে অংশ নেয়া ৩টি নির্বাচনের জন্য বন্ধ করে দিত।’ 

অবশ্য রাজনীতি করতে এসে কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা কিংবা সন্ত্রাস চালানোর কারণে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার ঘটনা বিশ্বে নতুন নয়। ৭৯ বছর আগে হিটলারের ন্যাশনাল সোসালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি বা সংক্ষেপে নাৎসী পার্টি এবং প্রায় একই সময়ে মুসোলিনির ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হয়েছিলো গণহত্যার অভিযোগে।

কিন্তু সংবিধানে যেখানে সংগঠন ও রাজনীতি করার অধিকার সংরক্ষিত আছে, তখন কোনো একটি দলকে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত কেমন? জানতে চাইলে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম বলেন, ‘কোনো দলকে নিষিদ্ধ করা এটা পৃথিবীতে নতুন কিছু না। আওয়ামী লীগও প্রচুর সংঘকে এর আগে সন্ত্রাস দমন আইনে ২ ধারায় নিষিদ্ধ করেছে, জামায়াত ইসলামীকে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করেছে। যদিও নির্বাহী আদেশে একটা দলকে নিষিদ্ধ করা জায়েজ কি না, এ নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ নিজের করা ফাঁদে নিজেই পড়েছে। যেটা তারা অন্য দলকে বিপদে ফেলার জন্য করেছিল, এখন সেটাতে তারা নিজেরাই পড়েছে। নিজেদের করা আইনে নিজেরাই নিষিদ্ধ হয়েছে।’

অবশ্য আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধসহ ৩ দফা দাবিতে টানা আন্দোলন এবং এর প্রেক্ষাপটে উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠক এবং বলা চলে চাপের মুখে আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধের ঘোষণায়ও ‘ফাঁকফোক’ দেখছেন কেউ কেউ।

সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া ঘোষণায় আওয়ামী লীগকে বিচার শেষ হবার আগ পর্যন্ত নিষিদ্ধের সীমা দেয়া হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে রাজনৈতিক দলের বিচারের সংশোধনী সংযুক্ত করে এরই মধ্যে অধ্যাদেশও জারি করা হয়েছে।

কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পর, একটা অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ঐকমত্য নিয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলো, তাতে কী সংকট দেখা গেলো? এই নিষিদ্ধের ব্যাপারে বিএনপির অস্পষ্ট অবস্থান নিয়ে এমন প্রশ্নে দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘যে পার্টি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে পারে না, তারা কিন্তু বেশিদিন টিকতে পারে না। যেমন মুসলিম লীগ থাকে নাই, আওয়ামী লীগ থাকেনি, সামনে বিএনপিও কী করবে আমি জানি না। বিএনপির অনেকের মধ্যেই হয়তো এমন ধারণা যে, ভারতের সহযোগিতা ছাড়া ক্ষমতায় টিকতে পারবে না। কিন্তু ভারত তো আওয়ামী লীগকে রাখতে চেয়েছিল, তারা পেরেছে কি?’

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম বলেন, ‘গত শাসনামলে বিশেষ করে গত জুলাই-আগস্টে যা কিছু করে গেছে, তা অত্যন্ত হীন কাজ। এর খেসারত তাদের দিতে হচ্ছে। তাদের দলীয় ব্যানারেও যদি এগুলো কেউ করে থাকে, তাহলে তারও দায় তাদের নিতে হবে।’

সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধের এই ঘোষণায় সাইবার স্পেসেও আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা মনে করছে, এতে গুজব ও অপপ্রচারের মত অপরাধ কমবে।

তথ্যপ্রযুক্তিবিদ তানভির হাসান জোহা বলেন, ‘প্রচলিত আইনে কোনো নিষিদ্ধ দল এবং জনগোষ্ঠী ফিজিক্যাল এবং সাইবার স্পেসে কার্যক্রম চালাতে পারবে না। যদি চালায়, তাহলে তাদের শনাক্ত করে পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগে নিষিদ্ধের একটা প্রভাব ভোটের মাঠেও পড়বে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী যে নতুন রাজনীতির আলোচনা হচ্ছে, তার পরিণতি নির্ভর করছে স্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়ার ওপর, মত তাদের।

এসএইচ